জাতীয় নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে বিএনপির তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরো বিস্তৃত হচ্ছে। দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর গ্রুপ-উপগ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে, প্রকাশ্যে পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ চলছে। ছড়িয়ে পড়ছে সহিংসতা। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকরা জড়াচ্ছে সংঘর্ষে। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ময়দান হয়ে উঠছে আরো সংঘাতপূর্ণ।

এতে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। তফসিল ঘোষণার পর এই বিরোধ-সংঘাত আরো প্রকট হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে বিএনপির হাইকমান্ডকে দ্রুত তৃণমূলের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত মেটাতে হবে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে দলটির ভূমিকা রয়েছে। 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩ নভেম্বর ২৩৭টি আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। এরপর থেকে মূলত দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে রূপ নেয়। অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। এ কারণে সব আসনেই এমপি হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন একাধিক নেতা রয়েছেন। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার পর মনোনয়নপ্রত্যাশী বঞ্চিত নেতারা ক্ষুব্ধ হন। তাদের অনুসারী নেতাকর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ-মিছিল-সমাবেশ অব্যাহত রখেছে। নেতারা লবিংয়ে ছুটছেন কেন্দ্রে। মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের পক্ষের নেতাকর্মীরাও এলাকায় শক্তির জানান দিচ্ছেন। একইসঙ্গে চালাচ্ছেন ভোটের প্রচারণাও। ক্ষমতার লোভে অসহিষ্ণু রাজনীতিতে গ্রুপ-উপগ্রুপের কোন্দল ক্রমশ সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু সহিংস ঘটনা ঘটেছে। হচ্ছে খুনোখুনিও।

এছাড়া সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সারাদেশে অনেক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, যদিও অনেকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ঘটনায় বহিষ্কৃতদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। পাশাপাশি কমিটি দেয়া, আবার তা বাতিল করা, নতুন কমিটি দেয়া, কমিটিতে পদ না পাওয়াসহ নানা কারণে অসন্তোষ রয়েছে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে। 

অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের (২০২৬) ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতার দাবি বা অভিযোগ করা হয়েছিল, সেগুলোরও প্রায় মীমাংসা করেছে সরকার। এখন বিএনপিও বলছে নির্বাচনে আর কোনো বাধা নেই। দীর্ঘ দিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বৈরিতার কারণে রাজনীতিতে সংকট আকাশ সমান তৈরি হলেও এখন প্রায় ম্রিয়মান। তবে দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গত এক বছরে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় এক অপরের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছে দলগুলো। রাজনৈতিক ময়দানে বিএনপির অন্তর্কোন্দল ভোটের রাজনীতির মাঠকে আরো সংকটে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

আরো পড়ুন : দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত ‘একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’, জানালেন তারেক রহমান

২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এক আসনে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল, একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ আমলে ওই নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিলের মতো ঘটনা ঘটলে আসন যেন বিএনপিশূন্য না হয়ে পড়ে, সেজন্য ওই কৌশল নেয়া হয় বলে তখন দলটির নেতারা জানিয়েছিলেন। তবে এবার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে আরো একটি বিষয় রয়েছে দলটির। আর তা হলো সমমনা বিভিন্ন দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করার প্রক্রিয়া চলছে। এই জোট হলে দলগুলোর চাহিদা অনুযায়ী আসন ছেড়ে দিতে হবে। এ কারণেও ৬৩টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি। বিএনপির অনেক হেভিওয়েট ও ত্যাগী নেতা দলীয় মনোনয়ন পাননি। এইসব বঞ্চিত নেতাদের মাঝেও ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে দলটির হাইকমান্ড বলছে, সব আসনে প্রার্থী একেবারেই চ‚ড়ান্ত নয়। পরিবর্তন হতে পারে। জোটকেও কিছু আসন ছেড়ে দিতে হতে পারে। অনেক নেতাকে এলাকায় কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। কিন্তু এই আশ্বাসেও ক্ষোভের আগুন নিভছে না। 

শুধুমাত্র গত এক সপ্তাহেই অন্তত ১০টি সংঘর্ষ ও বিক্ষোভ-প্রতিবাদে যুক্ত হন বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে রয়েছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন দিলীপ ও শহরের কান্দিপাড়া এলাকার লায়ন শাকিল গ্রুপের মধ্যে বিরোধের শিকার হয়েছেন সাবেক ছাত্রদল নেতা সাদ্দাম হোসেন (৩২)। বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি দিলীপের অনুসারী ছিলেন। এর আগের রাতে তিনজনকে গুলি করে শাকিল গ্রুপ। 

ঝিনাইদহ সদরের হুদা-ধনঞ্জয়পুর গ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বৃহস্পতিবার বিএনপির দুই পক্ষে সংঘর্ষ ও বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। ফুরসুন্দি ইউনিয়ন বিএনপি নেতা জাহিদ বিশ্বাস এবং ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি শাহাবুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। এর কয়েক দিন আগেও দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

মঙ্গলবার রাজশাহীর তানোরে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করেছে রাজশাহী-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত সুলতানুল ইসলাম তারেকের কর্মী সমর্থকরা। এই মশাল মিছিলে বাধা দেয় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনোনয়ন পাওয়া মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিনের সমর্থকরা। এতে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সাধারণ পথচারীসহ উভয় পক্ষের ১৫ জন আহত হয়েছে।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ওছখালীতে ২২ নভেম্বর (নোয়াখালী-৬) বিএনপি মনোনীত প্রার্থী কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবের রহমান শামীম এবং সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমের অনুসারীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘর্ষে পক্ষের কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন।

চট্টগ্রামের রাউজানে ৫ নভেম্বর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক (বিলুপ্ত কমিটি) গোলাম আকবরের এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পাঁচ নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়। এর আগেও দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। গত এক বছরে রাউজানে অন্তত ১২ জন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। 

শুধু নিজ দলের নয়, অন্য দলের সঙ্গেও সংঘাতে জড়াচ্ছে বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার বিকালে পাবনা-৪ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান এবং জামায়াত মনোনীত প্রার্থী জেলা জামায়াতের আমির আবু তালেব মন্ডলের নির্বাচনী প্রচারণায় দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় এক কর্মী গুলি ছুড়ে। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। 

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান ও টাঙ্গাইল-৮ আসনের দলীয় মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে সখীপুর উপজেলা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ১১ নেতাসহ ইউনিয়ন কমিটির প্রায় দুইশ নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা দেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শাজাহান সাজু ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাছেদ মাস্টারসহ দলের অন্য নেতারা। তারা আহমেদ আযম খানের মনোনয়ন বাতিল করে একজন সৎ, নীতিবান ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়ার আহ্বান জানান। 

গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের মনোনীত প্রার্থী মীর হেলালকে পরিবর্তন করে দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতা এস এম ফজলুল হককে মনোনয়ন দেয়ার দাবিতে মশালমিছিল ও সমাবেশ করেছেন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হকের অনুসারী ও বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। একই দাবিতে ১৪ নভেম্বর নেতাকর্মীরা উপজেলার চৌধুরীহাট ও সরকারহাটে সড়ক অবরোধ করেছিলেন। সিলেটে-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার) আসনে ধানের শীষের মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার করে ফয়সল আহমদ চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানিয়েছেন উপজেলার সিনিয়র নেতারা। ২৩ নভেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত আবেদন জানান তারা।

কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) আসনে মনোনীত প্রার্থী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি তাসভীর উল ইসলামকে পরিবর্তনের দাবিতে বৃহস্পতিবার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন দলটির একাংশের নেতাকর্মীরা। সমাবেশে দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) আব্দুল খালেককে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানান।