কিশোরগঞ্জ বিআরটিএ সার্কেলে ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি, দালাল-চক্র ও কর্মকর্তাদের অসদাচরণের অভিযোগে জর্জরিত এই অফিসে ভুক্তভোগীদের ন্যায্য অধিকার পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে। এই অফিস যেন ‘ঘুষ ছাড়া সেবা নয়’ নীতিতে চলছে। দালাল-চক্র, দুর্নীতি ও কর্মকর্তার ভয়ভীতি গ্রাহক সেবাকে করেছে জিম্মি। ড্রাইভিং লাইসেন্স অথবা গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে সাধারণ নাগরিকদের গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৮ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ। আর কেউ যদি ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে তাকে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে হয়রানি করা হয়।

ভুক্তভোগীরা জানান, ঘুষ লেনদেনের কাজটি হয়ে থাকে অফিসের কতিপয় কর্মচারী আর দালালের মাধ্যমে। অফিসের বাইরে দালালচক্র খোলামেলা টাকা লেনদেন করছেন। তাদের দাবি, অফিসের লোকজনের সঙ্গেই তাদের 'সমঝোতা' আছে। গাড়ির কাগজ, ফিটনেস, লাইসেন্স সব কিছুতেই তারা ‘সহজ সমাধান’ দিতে পারে, তবে তার মূল্য ৮ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত।

মিঠামইনের আব্দুল্লাহ আল সায়েম ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছেন, মেডিকেল টেস্ট, থিওরি, প্র্যাকটিক্যাল সব শেষ করেছেন ২০২৪ সালে, আট মাস ঘুরে তবুও লাইসেন্স হাতে পাননি। অফিসে গেলে বলে—‘স্যার বাইরে আছেন’, ‘ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না’, ‘কাল আসেন’। পরে বুঝি, ঘুষ না দিলে ফাইল এক ধাপও এগোয় না।

টাকা দিলেই কাজ, না দিলেই ঘুরতে হয়

একই ভাবে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন গাইটালের মো.আবদুল হাসেম তিনি বলেন, গাড়ির কাগজ করতে গিয়ে অফিসে ১০ বার যাওয়া হয়েছে। শেষমেশ এক দালাল বলল, ১৪ হাজার টাকা দিলে সব হয়ে যাবে। আমি রাজি হয়ে টাকা দিয়ে আজকে এক বছর হয়ে যাচ্ছে তবুও আমার কাগজপত্র ঠিক করতে পারছি না; ঘুরতে হচ্ছে অফিসের বারান্দায়, আজকে আবার আরেক দালাল টাকা চাচ্ছে ২ হাজার টাকা দিলে দ্রুত কাজ হয়ে যাবে। আমি টাকা না দিতে চাইলে আমাকে বলেন এক বছরের বেশি হয়েছে আরও বছর খানেক ‘তাহলে ঘুরে ঘুরে মরেন’।

লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন নান্দাইল থেকে আশা তানভীরুল হক মনে করেছিলেন সরকারি ফি দিলেই হবে কিন্তু না তাকেও দালালের খপ্পরে পরে দিতে হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রেও চলছে অনিয়ম, সেমিনারে উপস্থিত না থেকে লাইসেন্স ঘুষের বিনিময়ে নবায়ন করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ উপস্থিতদের জন্য বরাদ্দ থাকা সম্মানী ভাতা ও খাবারের টাকাও দেওয়া হয়নি।

বিআরটিএ অফিসের দুর্নীতির বিষয়ে ভোরের কাগজের সাংবাদিক যখন কিশোরগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পরিচালক কামরুজ্জামানের মুখোমুখি তখন তিনি দুর্নীতির কথা অস্বীকার না করে উল্টো বলেন, “এইসব বিষয় একটু ম্যানেজ করে নিতে হয়। আপনারাও একটু সহযোগিতা করেন, তাহলে এসব সমস্যা থাকবেনা। জাহাঙ্গীর সাহেব আপনি ভাইদের কে একটু দেখেন পাশের রুমে চা নাস্তা দেন বলে রুম থেকে বেরিয়ে যান।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটি কাম নিয়ে হাজির হন দালাল চক্রের গডফাদার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন (মোটরযান পরিদর্শক) কামটি দিতে ব্যর্থ হলে "নিউজ করে কি লাভ অযথাই হয়রানি করানোর কথা বলেন, আরও অনেক নিউজ হয়েছে কি হয়েছে আমাদের সারা বাংলাদেশে একি অবস্থা সব কি ঠিক করতে পারবেন আপনারা" আপনি আমার ভাই আর ভাই হয়ে ভাইয়ের ক্ষতি করবেন। 

যখন একজন সরকারি কর্মকর্তা নিজেই দুর্নীতিকে স্বাভাবিক হিসেবে মানছেন, তখন সাধারণ মানুষ কীভাবে ন্যায্য সেবা পাবে? কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট জুয়েল মাহমুদ বলেন, সরকারি অফিসে এইভাবে ঘুষ ছাড়া কাজ না হলে তা পুরো প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট করে। দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের উচিত দ্রুত তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য আলী হাসান বলেন, যে অফিসে মানুষ লাইসেন্স নিতে যায় নিরাপদ সড়কের জন্য, সেখানেই যদি ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স মেলে, তাহলে রাস্তায় নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত হবে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কিশোরগঞ্জ বিআরটিএ অফিসে যে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে, তা কেবল একটি অফিসের নয় বরং গোটা ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত এই অভিযোগগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। তা না হলে, সাধারণ জনগণের আস্থা চিরতরে হারিয়ে যাবে সরকারি সেবাব্যবস্থার প্রতি, মন্তব্য করেন আলী হাসান।