রপ্তানি কমার শঙ্কা নেই, আস্থার ঘাটতি বেড়েছে

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:২৪ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্কারোপের কারণে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, যার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, রপ্তানি কমবে না, বরং বাড়বে। তবে এ বিষয়ে সরকারকে মনোযাগী হতে হবে বলে মনে করেন তারা। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পার হলেও ব্যবসায়ী মহলে শান্তি, স্বস্তি কিংবা আস্থার ভিত শক্ত হয়নি। অর্থনীতির প্রাণশক্তি ব্যবসায়ীরা সরকারের কাঙ্ক্ষিত মনোযোগও পাননি; বরং উচ্চ সুদহার, বেশি দামেও গ্যাস সংকট, মুদ্রার অবমূল্যায়ণ, মব সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ নানা সমস্যায় বিপাকে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এর মধ্যেই আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ রপ্তানি খাতের জন্য আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা যখন সংকটময় পরিস্থিতি পার করছেন; তখন বিনিয়োগে চলছে মন্দা। কর্মসংস্থান হচ্ছে না, অনেকেই হারাচ্ছেন চাকরি। বন্ধ হচ্ছে ব্যবসা ও শিল্প কারখানা। অনেকে অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। তাদের পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা দিতে কমিটি গঠন হলেও নামমাত্র কিছু ব্যবসায়ীকে এ সুবিধা দিয়ে বেশির ভাগকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এমন অভিযোগ করছেন খোদ ব্যবসায়ীরাই।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা স্বীকার করছেন, যতক্ষণ না সরকার এই খাতকে আস্থায় নিয়ে একটি হয়রানিমুক্ত, নিরাপদ ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে; ততক্ষণ অর্থনীতির চাকায় আশানুরূপ গতি ফেরানো সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বেসরকারি খাতের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। বেসরকারি খাতের পরিস্থিতি ভালো করতে গেলে বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু টাকা থাকলে বিনিয়োগ হয় না। বিনিয়োগের জন্য পরিবেশ লাগে এবং স্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রয়োজন হয়। এমনিতেও আর্থিক খাতের অবস্থা ভালো নয়। আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার না আসবে, ততদিন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে উন্নতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল ভোরের কাগজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে আমি মনে করি, রপ্তানি আরো বেড়ে যাবে। কারণ, আমাদের এমন কোনো ট্যারিফ দেয়া হয়নি, যেটা পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে আলাদা করবে। ভারত এখনো নেগোশিয়েশন করছে। তারাও হয়তো কোনো না কোনো জায়গায় পৌঁছাবে। এরপরও আমরা ভালো অবস্থানে থাকব। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য বিক্রি কিছুটা কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ট্যাক্স মূলত পণ্যের ওপর গিয়ে বর্তাবে। অর্থাৎ পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একটা শ্রেণির মানুষ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। তবে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সরকারের কিছু করণীয় রয়েছে। সরকার যদি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের প্রতি মনোযোগী না হয়, তাহলে আমরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব। কারণ অদূর ভবিষ্যতে স্টেজ ভ্যালুএডিশন করতে হবে। সেক্ষেত্রে সুতা ও ফেব্রিক্স দুটোই দেশে তৈরি করতে হবে। তাই দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, ব্যবসাবান্ধব বলতে আমি বোঝাতে চাই, গ্যাস, বিদ্যুৎ স্বাভাবিক আছে কিনা। সেটা কতটুকু সহনীয় পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশে যখন প্যাকেজ প্রণোদনা দিচ্ছে, আমাদের সরকার কেমন দিচ্ছে? যেকোনও দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় স্বাভাবিক কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে একটু সংকোচিত থাকেন। বিটিএমএ সভাপতি বলেন, শিল্প বাঁচাতে না পারলে দেশে দুর্ভিক্ষ হবে।
ঢাকা চেম্বারের প্রেসিডেন্ট তাসকীন আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেলেও এখনো এর সুফল মিলছে না। এখনো পূর্ণাঙ্গ ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বা বড় আকারের বিনিয়োগ সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি, যা উদ্যোক্তাদের আস্থা বাড়াতে পারত। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, ঋণপ্রবাহের সীমাবদ্ধতা ও অবকাঠামোগত সমস্যাও ব্যবসায়ীদের বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন তিনি। তার বিশ্বাস দ্রুত যদি সরকার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ চালু করে এবং একটি বৃহৎ ব্যবসায়ী সম্মেলনের আয়োজন করে, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে তা সহায়ক হবে।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫ সালে নতুন করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে পারে। অন্যদিকে বিবিএসের হিসেবে, দেশে মোট কর্মসংস্থানের সরকারি অংশীদারি মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। বেসরকারি কর্মসংস্থান হয় ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। প্রায় ৬১ শতাংশের কর্মসংস্থান হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে। বাকি ২১ শতাংশ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, কারখানার নিরাপত্তা, ব্যাংকের উচ্চ সুদ হার, জ্বালানি সংকট, এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা সরকারকে বারবার বলে আসছি। এগুলো তাড়াতাড়ি নিষ্পতি না হলে অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান প্রত্যাশিত গতিতে বাড়বে না। রাজনৈতিক কারণে কিছু কারখানা মলিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। আবার কিছু ব্যবসায়ীকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। আমরা বিজিএমইএ থেকে উদ্যোগ নিয়েছি, আমাদের সদস্যদের যাতে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা না হয় সে ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ব্যাংকঋণের চাহিদা বাড়ছে না। ঋণপ্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, ২২ বছরের ইতিহাসে যা সর্বনিম্ন। কাঁচামালের আমদানিও কমে গেছে। নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। আগে যে কারখানাগুলো ছিল সেগুলোর মধ্যেও কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষণ নেই। নির্বাচিত সরকার না এলে ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে।
এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ পোশাকশিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বর্তমানে এলডিসি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশে শুল্কছাড় পেয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর এসব সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। এর ফলে পোশাকশিল্পের রপ্তানি খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা করা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় আরো উচ্চ শুল্ক আরোপিত হলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের জন্য বাজার ধরে রাখা কঠিন হবে।
সরকারের পদক্ষেপ ও ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, শুধু প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়, এর দৃশ্যমান বাস্তবায়ন প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব ধরনের হয়রানিমূলক মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করে ব্যবসায়ীদের নির্বিঘ্নে ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে। কারখানা ও ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন থেকে বিরত থেকে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও অনুমানযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করবে। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নিয়মিত সংলাপের মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে।