×

সাহিত্য

একদিন ডেমো ক্লাসের খপ্পরে

Icon

মাইমুনা প্রমা

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৩:০২ এএম

একদিন ডেমো ক্লাসের খপ্পরে

মাইমুনা প্রমা, শিক্ষার্থী, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)

২০২১ সাল থেকেই টিউশন করানো আমার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, তবে প্রতিদিন ক্লাস শেষে হাতে যে সময়টা অবশিষ্ট থাকে, সেটা কাটানোর মতো তেমন কোনো শখ বা সৃজনশীল অভ্যাস আমার নেই। তাই টিউশন করানোই আমার জন্য একপ্রকার ব্যস্ততা, দায়িত্ব এবং মানসিক প্রশান্তির মাধ্যম। পাশাপাশি, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করার সুযোগটাও আমাকে অনুপ্রাণিত করে।

সম্প্রতি মনে হলো, আরও কিছু শিক্ষার্থী পড়ানো উচিত। যত ব্যস্ত থাকবো, সময়ও তত দ্রুত এবং অর্থবহভাবে কাটবে—এই চিন্তাতেই নতুন টিউশন খুঁজতে শুরু করি। পরিচিত অনেক বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকেই শুনেছি, তারা টিউশন মিডিয়ার সাহায্যে বেশ ভালো কিছু টিউশন পেয়েছে। যদিও এর বিনিময়ে প্রথম বেতনের ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়েছে মিডিয়াকে।

বর্তমানে অনেক অনলাইন টিউশন মিডিয়া একটি নতুন পদ্ধতি চালু করেছে, যেটি হলো "ফ্রি ডেমো ক্লাস"। অর্থাৎ, টিউশন নিশ্চিত হওয়ার আগে অভিভাবকের অনুরোধে শিক্ষার্থীকে এক বা দুইটি ক্লাস করাতে হয় সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে। যদি অভিভাবক সন্তুষ্ট হন, তাহলে টিউশন শুরু করা যায়। তখন মিডিয়া ফিও দিতে হয়। আর যদি অভিভাবক সন্তুষ্ট না হন, তবে পুরো শ্রমটাই বৃথা যায়।

আমি কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপে টিউশন খুঁজে আবেদন করি। প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল ইতিবাচক—শিক্ষার্থী আগ্রহী, অভিভাবক আন্তরিক, পরিবেশ সহনীয়। আমি ভেবেছিলাম, প্রতিটি ডেমো ক্লাসই হয়তো এমন সম্মানজনক এবং সদ্ব্যবহারপূর্ণ হবে। কিন্তু দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা একেবারে ভিন্ন ছিল। আর সেটিই আমাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

প্রথম ডেমো ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে আসার সাথে-সাথেই সিদ্ধান্ত নিই যে, এই টিউশনটি আমি আর করাতে চাই না। কেন চাই না, তার সমস্ত কারণ খোলাসা করে টিউশন মিডিয়াকে জানাই, যা ধাপে ধাপে আপনাদের সাথেও শেয়ার করবো এখন।

মিডিয়া থেকে অভিভাবক আপুর নাম্বার পাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। কথোপকথনের মধ্যেই আমি নিশ্চিত হই যে, আমাকে দু’জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে হবে। একজন ক্লাস টেনে পড়ে (মেয়ে), যে শুধু ইংরেজি পড়বে আর অন্যজন ক্লাস ৪-এর ছেলে, যাকে সব বিষয় পড়াতে হবে।

তারা দু’জন ভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রী। আমাকে জানানো হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায় তাঁদের বাসায় যেতে, কারণ সেই সময়ে দু’জনই বাসায় উপস্থিত থাকবে। আমিও সম্মতি জানাই। ফোনে তাড়াহুড়োর কারণে আর বেশি কিছু আলোচনা হয়নি।

তাদের প্রস্তাবিত বেতন আমার কাছে যথেষ্ট সঠিক ও মানানসই মনে হয়েছিল, কারণ বাসার অবস্থান আমার নিজের বাড়ির একদম কাছেই। ফলে মনে হয়নি যে, দুইজন শিক্ষার্থীর জন্য সেটি কোনো খারাপ সম্মানী।

প্রথমত, লোকেশন আমার বাসার কাছেই ছিল, তাই ঠিক সময়েই চলে যাই। কিন্তু গিয়ে প্রায় ২০ মিনিট নিচে ওয়েট করতে হয়েছে কারণ ফোন ধরছিলেন না, আগে এক্স্যাক্ট টাওয়ার এবং ফ্ল্যাট নম্বরও বলেননি। (তাতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না, কারণ আমি নিজের ইচ্ছায়ই অপেক্ষা করছিলাম। বিল্ডিং/সোসাইটি  আমার চেনা ছিল এবং মানুষ ব্যস্ত থাকতেই পারে)। 

দ্বিতীয়ত, দুঃখিত এভাবে বলার জন্য, আমি একদমই জাজমেন্টাল নই তবে তাদের বাসার অবস্থা খুবই অগোছালো, যেখানে একজন সাধারণ মানুষের জন্য বসে থাকা বা লেখাপড়া করা যথেষ্ট কষ্টকর। পড়াশোনার কোনো পরিবেশই ছিল না।

তৃতীয়ত, ক্লাস টেনের বাচ্চা (মেয়ে) সিলেবাস কেনেনি ওর নাকি দরকার হয় না, তাই নেয়নি। তো আমি মান-বণ্টন দেখতে চাইলে সেটাও দেখাতে পারেনি। ঘরে একটাও ইংলিশ গ্রামার বা মডেল টেস্ট বই ছিল না। বলল স্কুল থেকে ফটোকপি দেয়, সেগুলোই পড়ে। (আমি দেখতে চাইলে আমাকে বলে আজকে আনতে পারবো না কালেকে দেখাবো)। এগুলো শুনে আমি অবাকই হয়েছি, কারণ নবদূত/চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন এর কোনো বই ছাড়া এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়াটা আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়েছে। যাইহোক, এরপর আমি EFT (English For Today) থেকে একটা লেসন পড়িয়ে বুঝিয়ে দেই।

ক্লাস ফোরের বাচ্চা (ছেলে) বারবার বলছিল নতুন চ্যাপ্টার শুরু করতে। আমি বলি, আচ্ছা, করছি। তবে আগে তুমি আমাকে কয়েকটা সহজ গুণ/ভাগ করে দাও যাতে বুঝি ও কতটুকু পারে। কারণ ও গুণনীয়ক-গুণিতক নিয়ে চ্যাপ্টার শুরু করতে চাইছিল। আমি চারটা গুণ করতে দেই, কিন্তু ও করেনি। ওর মা আমাদের সামনেই বসা ছিলেন। বাচ্চা বলছিল ও করবে না। ওর মা আমাকে বললেন, “আজকে ওর এক্সাম শেষ, তাই করতে চাইছে না। আপনি নতুন চ্যাপ্টার শুরু করে দিন।”

আমি বললাম, “আপু, করাবো অবশ্যই, কিন্তু এইগুলো তো খুব সাধারণ গুণ।” উনি আবার ছেলেকে বললেন, “নেক্সট দিন থেকে ম্যামের কথা শুনবা।” অর্থাৎ আমাকে পরোক্ষভাবে বোঝাচ্ছিলেন যেন ওকে ওইগুলো না করাই। যাইহোক, আমি ঠিকই করিয়ে নিই পরে, যতই বাচ্চা ইগনোর করুক না কেন! 

আমরা বিছানার ওপর বসে পড়ছিলাম, এটা কিছুটা নরমাল। কিন্তু ছেলেটা যথেষ্ট বড়, একটু পর পর শুয়ে গেম খেলছিল ফোনে। মা সামনেই বসে থেকেও কিছু বলেননি। ন্যূনতম শিষ্টাচার ছিল না, যা আমার চোখে খুবই অস্বস্তিকর লেগেছে।

সবশেষে, উনারা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, “টিউশন মিডিয়া আমাকে কয়জন স্টুডেন্ট পড়ানোর কথা বলেছেন?”। আর ফ্রি ডেমো ক্লাস কয়টা করাবো। এই সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি তাদের বাসা থেকে বিদায় নেই। 

উনি প্রথম ফোন কলেই বারবার বলেছিলেন আমাকে, “ডেমো ক্লাস করান, তারপর বাচ্চারা বুঝতে পারলে জানাবো টিউশন কনফার্ম কী না, অথচ আমি তা জানতেই চাইনি।” স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল, তারা একজন মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগের চেয়ে বিভিন্ন শিক্ষক দিয়ে ফ্রি ডেমো ক্লাস নেওয়াতেই বেশি আগ্রহী।

সবশেষে বাসা থেকে ফিরে সিদ্ধান্ত নিই, এই টিউশনটি আমি নেব না। আমার অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে টিউশন মিডিয়াকে জানাই এবং আমি আর এই শিক্ষার্থীদের পড়াতে আগ্রহী নই সেটাও জানিয়ে দেই। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমার উপলব্ধি—সব টিউশন অফার, সব অভিভাবক কিংবা সব শিক্ষার্থীই একরকম হয় না।

টিউশন বা শিক্ষাদান কেবল অর্থের বিনিময় নয়—এটি একটি সম্মানজনক পেশা, যেখানে দায়িত্ব, পরিশ্রম ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। ‘‘ফ্রি ডেমো ক্লাস’’ এর নামে শিক্ষকের শ্রমের অবমূল্যায়ন যেন না হয়—এই প্রত্যাশা সবার কাছে।

মাইমুনা প্রমা, শিক্ষার্থী, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

শাসকের রাজনীতি বনাম শোষিতের লাশ

শাসকের রাজনীতি বনাম শোষিতের লাশ

একদিন ডেমো ক্লাসের খপ্পরে

একদিন ডেমো ক্লাসের খপ্পরে

গোপালগঞ্জে জঙ্গি কায়দায় হামলা চালানো হয়েছে: নাহিদ ইসলাম

গোপালগঞ্জে জঙ্গি কায়দায় হামলা চালানো হয়েছে: নাহিদ ইসলাম

গোপালগঞ্জে বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত

গোপালগঞ্জে বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App