স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি
করিডোর দিলে ও বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলে দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ১০:০৭ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
‘করিডর/চ্যানেল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ (সেন্টমার্টিন), বন্দর ও দেশীয় বাণিজ্য সংকট: দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও প্রেস ব্রিফিং করেছে স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি। মঙ্গলবার (২৭ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে এটি অনুষ্ঠিত হয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির আহ্বায়ক মুহম্মদ জিয়াউল হক বলেন, করিডোর শব্দের পরিবর্তে এখন আমরা রাখাইনে মানবিক চ্যানেল দেয়ার অস্পষ্ট বক্তব্য শুনছি। আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি- রাখাইনে করিডর/চ্যানেল কিংবা ভিন্ন নামে কিছু দিতে হলে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সাথে বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের টেকসই লাভক্ষতির চুল-চেরা আলোচনা-পর্যালোচনা না করে এবং জনগণের কন্সেন্ট (সম্মতি) না নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার মানবিক চ্যানেল দিতে পারে না। একইসাথে প্রচুর ভারতীয় স্টাফ কর্মরত এবং আমেরিকা ও ইজরাইলের সাথে একাধিক সমঝোতা ও চুক্তিবদ্ধ বিদেশি প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালনায়ও যুক্ত করতে পারে না।
তিনি বলেন, এখানে রাখাইনে মানবিক চ্যানেলের সম্পূরক (সাপ্লিমেন্টারি) হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি অপারেটরের হাতে ন্যস্ত করা হচ্ছে কি না সেটিও স্পষ্ট করা দরকার। নইলে দেশব্যাপী শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও, নিজেদের টাকায় তৈরি লাভজনক নিউমুরিং টার্মিনালটিকে মার্কিন মদদপুষ্ট ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে ন্যস্ত করার এতো তোড়জোর কেন? বন্দর ও চ্যানেলের মধ্যে যোগসূত্র থাকায় এতে প্রক্সি যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হবে। চীন-মিয়ানমার বনাম আমেরিকা-ভারত। এই চার রাষ্ট্রের স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিনা স্বার্থে বাংলাদেশ হবে বলির পাঁঠা! এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থিতিশীল হবে। পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কে দেয়া হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা আরো দীর্ঘায়িত হবে। এদিকে, মানবিক চ্যানেলের শুরুর কথা বলা হলেও এর শেষ পরিণতি কী, কীভাবে শেষ হবে এর কোনো রূপরেখা সরকার দিচ্ছে না। কাজেই জনগণকে অন্ধকারে রেখে ভিন্ন নামে চ্যানেল দেয়া ও বন্দর পরিচালনায় বিদেশীদের নিয়ে আসা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছে স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি।
স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির আহ্বায়ক বলেন, নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি (কূটনৈতিক কর্তৃপক্ষ তৈরি), নিজ ভূমি পুনরুদ্ধার ও তথায় স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে সক্ষম করে তোলাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের টেকসই সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই আরাকান অঞ্চলকে রোহিঙ্গা শাসিত (রোহিঙ্গা ডোমিন্যান্ট) অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিপরীতে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গণহত্যায় ল্প্তি আরাকান আর্মিকে দুর্বল করে রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে এমন কোনো রাষ্ট্র কিংবা সংস্থাকে যুক্ত করা যাবে না, যেই রাষ্ট্র বা সংস্থা বাংলাদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে কিংবা যাদের কারণে বাংলাদেশ নিজেই প্রক্সি রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে! মূলত এসব স্পর্শকাতর বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়।
গণমাধ্যম বিষয়ক সংগঠন মিডিয়া মনিটরের প্রধান সমন্বয়ক আহসান কামরুল বলেন, সেন্টমার্টিন, করিডোর ও বন্দর নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতায় এসে অভিযোগের সেই জায়গাগুলোতে সরকারের হাত দেওয়া উচিৎ ছিল না। সেন্টমার্টিনে হাজার মানুষ কর্মহীন। সেখানে বিনিয়োগ করা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত। পরিবেশ উপদেষ্টা ঢাকার ধুলাবালি কমাতে পারেন না, তিনি পড়ে আছেন সেন্টমার্টিন নিয়ে! বন্দরের বেলায়ও একই কথা। গত এপ্রিলেও বলেছি, এখনও বলছি। রাজনৈতিক দলসহ জনগণের সাথে আলোচনা না করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা সরকার এবং অভ্যুত্থানের সহায়ক শক্তি সেনাবাহিনীর সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এটা কোনভাবেই আমাদের কাম্য নয়। সরকার এবং সেনাবাহিনী দু'পক্ষকেই আরও সহনশীল হতে হবে। যেকোন বিষয় আলোচনা থাকলে প্রোপার চ্যানেলে করতে হবে। সব বিষয় জনসম্মুখে এনে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হুমকিতে ফেলা যাবে না। ভারত কিংবা অন্য কোন বহিঃশক্তিকে সুযোগ দেওয়া যাবে না। এসময় সীমান্তে ভারতের করা পুশ-ইনের বিরুদ্ধে সরকার এবং সেনাবাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান মিডিয়া মনিটরের প্রধান সমন্বয়ক।
স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টির যুগ্ম আহ্বায়ক মুহিউদ্দিন রাহাত বলেন, পরিবেশবাদের নামে নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপে (সেন্ট মার্টিন) সরকারি বাধা-নিষেধে ৪ ধরণের সমস্যা তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে। যথা- মৌলিক-মানবাধিকার হরণ, পযটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ, পরিবেশ নষ্ট ও সার্বভৌমত্বগত ঝুঁকি। এক. স্বাধীনভাবে চলাফেরা, চিকিৎসা ও রুটি রোজগারের পথ বন্ধ করে দেয়ায় অর্থাৎ সাভাবিক জীপন-যাপনে সরকারি বাধা-নিষেধ আসায় দ্বীপের সাধারণ মানুষের মৌলিক-মানবাধিকার হরণ করা হচ্ছে। দুই. দেশের পযটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিপরীতে, দেশীয় পযটক ও বাংলাদেশে আগত বিদেশি পযটকরা ভারতসহ আশপাশের রাষ্ট্রে ঘুরতে চলে যাচ্ছে। এতে দেশের রিজার্ভ তথা অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, তিন. পরিবেশগত ঝুঁকি: কর্মসংস্থান না পেলে দ্বীপের মানুষ কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ, ঝিনুক কড়ি আহরণ, সামুদ্রিক শেওলা উত্তোলন, কোরাল কেটে বিক্রী করা ও ব্যাপকভাবে কেয়া গাছ কেটে ফেলবে। ফলে কথিত পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি হবে। চার: স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা ও চলাফেরায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় দ্বীপের সক্ষম জনগোষ্ঠী দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অক্ষমরা বিনা চিকিৎসায়, অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছে। কুরবানির ঈদের পর দ্বীপে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে মর্মে দ্বীপবাসী দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। পরিবেশ উপদেষ্টার অমানবিক সিদ্ধান্তের কারণে সক্ষমরা দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে পারলেও অক্ষমরা হয়তো সামনের দুর্ভিক্ষে চিকিৎসা ও খাবারের অভাবে নি:শেষ হয়ে যাবে! এতে দ্বীপটি জনশূণ্য হয়ে যাবে। ফলে পার্শবর্তী রাখাইনের মগ, আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের দাবিকৃত দ্বীপটি বাংলাদেশের হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। অতএব, অতি পরিবেশবদী চিন্তা বাদ দিয়ে মানবিক সংকট ও দেশের অখণ্ডতা রক্ষার তাগিদে নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ ভ্রমণে সব ধরণের সরকারি বাধা-নিষেধ প্রত্যাহার চায় স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি।
মুহিউদ্দিন রাহাত আরো বলেন, দেশীয় ব্যবসায়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সরকারের অমনোযোগ ও বিমাতাসুলভ আচরণে গত আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত গত আট মাসে দেশের রপ্তানিমুখী ১১৩টি তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে। চাকরি হারিয়েছে প্রায় ১ লক্ষ শ্রমিক। এদিকে, ব্যবসায়ী সংগঠন, এনবিআর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে আলোচনা না করেই বৈদেশিক সংস্থা আইএমএফের পরামর্শে মধ্যরাতের অধ্যাদেশে জাতীয় রাজস্ব বিভাগ (এনবিআর) বিলুপ্ত করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এমন সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে! রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সাথে জড়িত এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাধারণত সংসদে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেখানে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের সাথে আলোচনা না করে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এসব অনধিকার চর্চা। এসব স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের থাকে না।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত আলেম ও তাহরিকে খতমে নবুওয়্যাতের আমির ড. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মীর ইদ্রিস নদভী, বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইলিয়াস মাতাব্বর, আম-জনতার দলের সদস্য সচিব তারেক রহমান, সাংবাদিক ও গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইঞ্জি. শাহাদাৎ ফরাজী সাকিব প্রমুখ।