শারদীয় দুর্গোৎসব
থিমের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের ‘একচালা প্রতিমা’

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৪৬ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
থিম পূজার ভিড়ে প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে ‘একচালা প্রতিমা’। বিভিন্ন পূজামণ্ডপে প্রতিটি দেব-দেবীর মূর্তির দেখা মেলে আলাদা আলাদা চালায়। তবে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন ছাড়াও পুরান ঢাকার হাতেগোনা দু-একটি বনেদি বাড়ির পূজায় এখনো দেখা মেলে একচালা প্রতিমার। একচালা হচ্ছে একটা চালচিত্র। সেই কাঠামোর প্রতিমায় দেবী দুর্গা তার চার সন্তান কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী একসঙ্গেই থাকেন।
জানা যায়, একচালা প্রতিমা কাঠামোতে চালচিত্র আদতে দুর্গাপ্রতিমার উপর বা পেছন দিকে যে অর্ধবৃত্তাকার পটভূমি দেখা যায় সেটি। এখানে মূলত নানা দেবী, দেবতার কাহিনী আঁকা থাকে। বাঁশ এবং খবরের কাগজ ব্যবহার করে বানানো হয় চালচিত্র। তারপর আঁকা হয়। ফুটে ওঠে শিব, পার্বতী, কালী, চণ্ডী, দশমহাবিদ্যাসহ নানা দেব-দেবীর ছবি। দেবী দুর্গার আদি প্রতিমা একচালাই হয়। কিন্তু থিম বদলে দিয়েছে একচালার সেই ধারণা।
অনেক দিন আগেই একচালা রীতি ভেঙে ‘ভিন্ন’ হন দুর্গা আর তার সন্তানরা। দেবীর কাঠামোতে এখন আমরা সাতটি মূর্তি দেখতে পাই। দেবী মূর্তির দুই পাশে আলাদা কাঠামোতে থাকে তার চার সন্তানের মূর্তি। মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা। দুর্গার পদতলে একদিকে সিংহ ও অন্যদিকে অসুর। দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে এবং বা পায়ের শ্রী আঙ্গুলী অসুরের কাঁধে স্থাপিত। দেবীর ডানে ধনদাত্রী লক্ষ্মী, পাশে সিদ্ধিদাতা গণেশ। দেবীর বামপাশে বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী এবং তার পাশে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক কার্তিক।
একচালা প্রতিমার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন। একচালা প্রতিমা প্রসঙ্গে ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ মহারাজ ভোরের কাগজকে বলেন, একচালা প্রতিমা হচ্ছে পরিবার সমন্বিতা প্রতিমা। ৬০-৭০ বছর আগেও পরিবারগুলো ছিল যৌথ পরিবার। আমরা দেখেছি, যৌথ সেই পরিবারে ঠাকুর দা-ঠাকুমা, জেঠা-জেঠিমা, কাকা-কাকিমা, বাবা-মা, ভাই-বোন যেমন ছিল তেমনি গৃহপালিত পশু-পাখিরাও ছিল। একচালা প্রতিমা কাঠামোতেও আমরা দেখি তেমন প্রতিচ্ছবি। সেখানে দেব-দেবীর যেমন অবস্থান তেমনি তাদের বাহন-হাঁস, পেঁচা, ইঁদুর, ময়ুরও দেখতে পাই। এর মানে এটি একটি যৌথ পরিবারের দৃশ্যপট। এই ধারণা থেকেই একচালা প্রতিমা। কিন্তু এখন যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে। একক পরিবার হয়েছে। সেই ভাবটাই ফুঠে ওঠে এখনকার প্রতিমায়। প্রতিটা দেব-দেবীকে রাখা হয় আলাদা আলাদা চালায়। তার মানে যৌথ পরিবার নেই। একক পরিবারের প্রতিচ্ছবি সেখানে দেখা যায়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, চালচিত্র মূলত চার রকমের হয়, মার্কিনি চাল, বাংলা চাল, মঠচৌড়ি চাল এবং টানাচৌড়ি চাল। এই চারটির মধ্যে মার্কিনি চাল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। মার্কিনি চালের মধ্যে মূলত দেবী প্রতিমার দুই দিকে দুটো থাম থাকে, আর দুই পাশ থেকে অর্ধচন্দ্রাকার চাল থাকে। বাংলা চালে এই থাম দুটি থাকে না। টানাচৌড়ি চালে থাকে কার্নিশ মতো একটি আকার। সঙ্গে থাকে তিনটি চ‚ড়া। মঠচৌড়ি চালে প্রতিমার মাথায় অর্ধেক চাঁদের মতো তিনটি খোপ থাকে। মনে হয় যেন ঢেউ খেলে গিয়েছে দেবীর মাথায়।
শুধু তাই নয়, সনাতন প্রথা ভেঙে প্রতিমা নির্মাণেও এসেছে নতুনত্ব আর ভিন্নতা। কোথাও তিনটি অসুর, আবার কোথাও একাধিক সিংহ, মহিষ, কোথাও ১০ হাতের পরিবর্তে দেবী দুর্গার অসংখ্য হাত ও মাথা। ধান, চাল, পাটসহ নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে প্রতিমা। ভক্ত ও দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করতেই থিমভিত্তিক মণ্ডপগুলোতেই এই ধরনের উদ্যোগ নেন আয়োজকরা।
প্রতিমাশিল্পীরা বলছেন, সময়ের চাহিদা আর প্রতিযোগিতার ভিড়ে একচালা প্রতিমা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এখন কার প্রতিমা ও মণ্ডপ বেশি আকর্ষণীয় তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। আগে এমনটা দেখা যেত না। কিন্তু এখন দর্শনার্থী ও ভক্তদের টানতে আয়োজনে জৌলুসের প্রাধান্য দেন। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই আয়োজকদের ফরমায়েশ মতো প্রতিমাশিল্পীরা নির্মাণ করেছেন নানা ডিজাইনের প্রতিমা। তবে শাস্ত্রে একচালা পূজার কথাই বর্ণিত আছে।