×

মতামত

শহীদের রক্তের প্রতি রাজনীতির বিশ্বাসঘাতকতা

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫, ০২:৪৫ এএম

শহীদের রক্তের প্রতি রাজনীতির বিশ্বাসঘাতকতা

জুলাই শহীদের প্রতীকী ছবি

পৃথিবীর ইতিহাসে এত দ্রুত মানুষ এত বড় ঋণ ভুলে গেছে—এমন নজির বিরল। নাহিদ-আসিফদের কারণে বাংলাদেশ শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা পায়নি, পেয়েছে এক বিকল্প, অদৃশ্য কিন্তু গভীরতর স্বাধীনতাও—চেতনার, মর্যাদার, আত্মপরিচয়ের। তারা রক্ত দিয়েছে, অশ্রু দিয়েছে, সম্ভাবনাময় জীবন বিসর্জন দিয়েছে—শুধু যাতে আমরা একদিন মাথা উঁচু করে বলতে পারি, “আমরা মানুষ, আমরা স্বাধীন।”

আজ আমি পরবাসে বসে স্বাধীনভাবে লিখতে পারছি—এটাও তাদের আত্মত্যাগেরই প্রতিফলন। কিন্তু যে রক্ত শুকায়নি, যে চোখের পানি এখনো শুকায়নি, সে জাতি কি এত তাড়াতাড়ি তাদের ভুলে যেতে পারে? আমরা কি ভুলে গেছি কারা চুপিসারে নিখোঁজ হয়ে গেলেন? কারা হঠাৎ করে কোনো চার্জশিট ছাড়াই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হয়ে গেলেন? কে বা কারা রাতের অন্ধকারে মায়ের কোল থেকে তুলে নিয়ে গেল এক বুক সাহসী সন্তানকে?

আমরা কি জানি, যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে তারা বেঁচে থাকলে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেন, গবেষক হতেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতেন। কিন্তু তারা বেছে নিয়েছিল মৃত্যুর সম্ভাবনা, শুধু যাতে জাতি একদিন সত্যের পাশে দাঁড়াতে পারে। আর আজ আমরা কী করছি?

আমরা বিলবোর্ডে অন্য কারও মুখ টাঙাই, যারা তখন নিষ্ক্রিয়, সুবিধাবাদী, অথবা নিঃশব্দ দর্শক ছিল। আমরা হ্যাশট্যাগে আর ট্রেন্ডে বাঁচতে শিখেছি—ইতিহাসের ভার বহন করার সাহস আমাদের নেই। আর সেই সাহসী ছেলেমেয়েদের নাম কেউ উচ্চারণ করলেও অনেকে মুখ বিকৃত করে, কেউ কেউ বলে—“ওরা উসকানিদাতা ছিল, অশান্তি চেয়েছিল।” তাদের আত্মত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু হয়েছে—যেন স্বাধীনতা শুধু একটি তারিখ, একটি জাতীয় পতাকার ছাপ, অথবা একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন!

সামনের মাসগুলো আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে শুরু করেছে গত বছরের সেই বিভীষিকাময় সময়টিকে—যখন শিক্ষার্থীরা মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে রাজপথে নেমেছিল, মুখে স্লোগান আর চোখে অদম্য সাহস নিয়ে। তারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল—কোনো বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে নয়, কোনো ধর্মীয় বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নয়—তারা যুদ্ধ করেছিল একদল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে, যারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করে জাতিকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে চেয়েছিল।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়—যাদের দায়িত্ব ছিল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাদের বেতন দেওয়া হয় রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের কষ্টার্জিত অর্থে, সেই রাষ্ট্রীয় বাহিনীই একপর্যায়ে স্বৈরাচারের সহচরে পরিণত হয়ে হাজারো শিক্ষার্থীর ওপর গুলি চালিয়েছে, অনেককে হত্যা করেছে। যেখানে রক্ষা করার কথা ছিল, সেখানে হত্যা ঘটেছে। যেখানে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা ছিল, সেখানে অন্যায়কে ঢাল বানানো হয়েছে। তখন তরুণেরা রাস্তায় নেমেছিল—কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নয়, বুকভরা সাহস নিয়ে। তারা বলেছিল, “এবার আর না।”

কিন্তু কেউ কেউ তাদের অবমূল্যায়ন করে বলেছিল, “এরা তরুণ, আবেগে চলছে।” কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—প্রতিটি মহান বিপ্লবের সূচনা ঘটেছে তরুণদের হাত ধরে। আর আজ? সেই সাহসী তরুণদের কেউ আজ হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতর, কেউ চিরতরে পঙ্গু, কেউ নিখোঁজ কিংবা বিদায় নিয়েছে এই পৃথিবী থেকে। আমরা তাদের ভুলে যাচ্ছি—আমরা নির্লজ্জভাবে ভুলে যাচ্ছি।

নেতারা তাদের নাম নেয় না, মিডিয়া তাদের ছবি দেখায় না, ইতিহাস বইয়ে তাদের জায়গা নেই। এটাই আমাদের জাতিগত ব্যর্থতা—আমরা কৃতজ্ঞতা ভুলে গেলে জাতি হয়ে উঠি না, ভিড় হয়ে যাই। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সামনে আরও কঠিন কিছু প্রশ্ন রাখছে—একটি রাষ্ট্র যেখানে বিচার নেই, যেখানে সত্য বললেই তা ‘ষড়যন্ত্র’ হয়, যেখানে সাহসী কণ্ঠস্বরগুলোকে রাতের অন্ধকারে নিস্তব্ধ করে দেওয়া হয়, সেখানে ভবিষ্যৎ কোথায়? যে জাতি নিজের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে জানে না, সে জাতি কীভাবে এগোবে? 

তাই এই লেখা আমার নয়—এই লেখা আসলে গণঅভ্যুত্থানে জড়িতদের কান্না, লাখো শিক্ষার্থীর অভিমান। যারা নিখোঁজ, যাদের খবর কেউ রাখে না, যারা ঘুমহীন রাতের গোপন সাক্ষী হয়ে থেকেছে কোনো নামহীন গলির ধারে—এই লেখা তাদের হয়ে বলা এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

আমি শুধু একজন দূরের মানুষ—একটা মানচিত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাক্তন শিশু মুক্তিযোদ্ধা, এক প্রাক্তন নাগরিক, এক নিরন্তর রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আমার চারপাশে কেউ নাহিদকে চেনে না, কেউ জানে না আসিফ কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিল, কেউ জানে না কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়নি কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে এবং কেনই বা আমরা তখন চুপ ছিলাম, প্রতিবাদ করিনি?

তবু আমি জানি—যারা এই দুষ্টচক্রের ভিতর সক্রিয় ছিল, তারা আজও আছে। কারণ যতবার এই জাতি মিথ্যার সঙ্গে আপস করে, ততবার তাদের আত্মত্যাগ আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে আরও লাল হয়ে জ্বলে ওঠে এই পতাকার গভীরে। আমার হাতে এখন কোনো পতাকা নেই, নেই কোনো মিছিল, নেই কোনো স্লোগান বা প্রতিশ্রুতি।

শুধু একরাশ অপরাধবোধ আছে, আর আছে অব্যক্ত কৃতজ্ঞতা যা হয়তো জাতি ভুলে গেছে, কিন্তু আমি এখনও ভুলিনি। এটাই আমার দায়, এটাই আমার দুঃখ, এটাই আমার নিঃসঙ্গ প্রতিবাদ একটি অকৃতজ্ঞ সময়ের বিরুদ্ধে কিছুটা কৃতজ্ঞতা নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকা দূর পরবাস থেকে এক রেমিট্যান্স যোদ্ধা। 

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন), [email protected]

[প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভোরের কাগজ সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের; ভোরের কাগজ কর্তৃপক্ষের নয়।]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

পরিবেশ রক্ষায় সাহসী সাংবাদিক রিনা আকতার তুলির অনন্য ভূমিকা

পরিবেশ রক্ষায় সাহসী সাংবাদিক রিনা আকতার তুলির অনন্য ভূমিকা

নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া যেন সাফল্যের সবচেয়ে সহজ রাস্তা

নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া যেন সাফল্যের সবচেয়ে সহজ রাস্তা

ভারতে বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে যা বললেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী

ভারতে বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে যা বললেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী

ভারতে বিমান বিধ্বস্ত, বাকরুদ্ধ বলিউড তারকারা

ভারতে বিমান বিধ্বস্ত, বাকরুদ্ধ বলিউড তারকারা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App