নোনাজলে ভেসে থাকা স্বপ্ন: উপকূলীয় কৃষির অভিযোজন ও সম্ভাবনার পথরেখা

মো: শাহীন হোসেন
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৫:৪৯ পিএম

সারা বছর উৎপাদনে সক্ষম লবণাক্ত সহনশীল ও উচ্চফলনশীল সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছে নোনা এলাকার প্রান্তিক কৃষকরা
নোনাধরা হাওয়া আর লবণাক্ত মাটির বুক ছুঁয়ে প্রতিদিন সূর্য ওঠে বাংলাদেশের উপকূলে। এটি শুধুই প্রকৃতির এক নির্মম উপস্থাপনা নয়—এখানে প্রতিটি দিনই নতুন করে বাঁচার লড়াই। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই গড়ে উঠছে এক নবতর জীবনের গল্প। যেখানে পানির সঙ্গে সংগ্রাম শুধু বাধা নয়, বরং সম্ভাবনারও উৎস।
বর্তমানে উপকূলীয় কৃষির দৃশ্যপটে এসেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ এক অভিযোজন—ভাসমান বাগান, চিংড়িঘেরে হাঁস-মুরগির সহাবস্থান, প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি মনিটরিং, নারী নেতৃত্বাধীন খামার ও তরুণ উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। জলবায়ু পরিবর্তন বদলে দিয়েছে মাটি ও মুনাফার ধারা, কিন্তু বদলাতে পারেনি মানুষের সাহসিকতা। প্রতিদিন লড়াই চলছে নদীভাঙন, লবণাক্ততা ও জলোচ্ছ্বাসের বিপরীতে। এই প্রতিরোধই গড়ে তুলছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও অভিযোজন সক্ষম উপকূল—যা বিশ্বব্যাপী অনুসরণযোগ্য মডেল হিসেবে দেখা যেতে পারে।
উপকূল: সংকটের মাঝে সম্ভাবনার দিগন্ত
বাংলাদেশের উপকূলীয় রেখা ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং সমুদ্রসীমা ছুঁয়ে রয়েছে প্রায় এক লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এই অঞ্চল শুধু ভূগোল নয়, অর্থনীতি, খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু। এখানে প্রায় ২ কোটি মানুষ সরাসরি জীবিকা নির্বাহ করে কৃষি, মৎস্য ও পর্যটনের ওপর নির্ভর করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে লবণাক্ততার বিস্তার, ভূগর্ভস্থ পানির সংকট, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন এবং খরার প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে।
মৎস্য খাতে অভিযোজন: সাফল্য ও সংকেত
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট মাছ উৎপাদন ৪.৯২ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। যদিও জাতীয় জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান সামান্য হ্রাস পেয়ে ২.৪১% হয়েছে, কৃষি জিডিপিতে এর অবদান ২১.৮৩%—যা একটি উল্লেখযোগ্য বাস্তবতা। প্রায় ১.৯ কোটি মানুষ এই খাতে নিয়োজিত, যার মধ্যে নারীর ভূমিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় উপকূলীয় অঞ্চলে ইলিশ সংরক্ষণ, ফিশিং লাইসেন্স প্রদান ও সুরক্ষিত মাছ সংরক্ষণের এলাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
তবে আশঙ্কার জায়গাও রয়েছে—প্রায় ২৮% উপকূলীয় মাছের প্রজাতি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। জলবায়ু সহনশীল এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের দাবি।
ভাসমান কৃষি ও লবণসহিষ্ণু প্রযুক্তির বিপ্লব
পানি জমে থাকা জমিতে কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ভাসমান বেডে সবজি চাষ এখন শুধু একটি কৃষি কৌশল নয়, বরং এটি ইউনএফএও কর্তৃক গ্লোবাল অ্যাগ্রিকালচারাল হেরিটেজ সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে উপকূলের হাজারো ভূমিহীন পরিবার ৮-৯ মাস সবজি উৎপাদন করে থাকে। এছাড়া লবণসহিষ্ণু ধান, পাটশাক, কুমড়া, ডাঁটা জাতীয় ফসলের জাত উদ্ভাবন করে কৃষকরা এখন সংকটকেও পুঁজি করে আয় ও পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করছেন।
‘আমার আগে শুধু চিংড়ি ছিল, এখন সবজি, হাঁস আর দেশি মাছ—একসাথে সব পাই, আয়ও বেড়েছে’—বললেন সাতক্ষীরার তালার কৃষক মোস্তফা গাজী।
প্রাণিসম্পদ ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য কৃষির পথে
বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে এমন মুরগি যার লিঙ্গ আগে থেকেই নির্ধারণযোগ্য। মাছ ও চিংড়ির বর্জ্য দিয়ে গরুর খাদ্য তৈরির গবেষণা এখন বাস্তবায়নের পথে। একইসাথে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মনিটরিং এবং নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয় ও উন্নয়ন অংশীদাররা। এই উদ্যোগগুলো দেশের খাদ্য শৃঙ্খলা, পুষ্টি এবং উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হচ্ছে।
অর্থনীতি ও পরিবেশ: একে অন্যের পরিপূরক
সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন খাত থেকে বছরে প্রায় ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হচ্ছে, যা স্থানীয় অর্থনীতির অনুঘটক। কিন্তু পরিবেশ দূষণ, লবণাক্ততা ও জীববৈচিত্র্য হ্রাসের কারণে মাছ, মধু ও বনজ সম্পদ হুমকির মুখে পড়েছে। মৃত্তিকা গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় ১৬২টি স্থানে লবণের মাত্রা ০.০৫ থেকে ৯.০৯ সঝ/পস পর্যন্ত পাওয়া গেছে। অঞ্চলভিত্তিক অভিযোজন কৌশলের জন্য এই ডেটা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হিসেবে কাজ করছে।
ভবিষ্যতের রূপরেখা ও আন্তর্জাতিক সংযোগ
লবণসহিষ্ণু পশুপালন, সামুদ্রিক শৈবাল ও কাঁকড়ার চাষ, সেন্সরভিত্তিক ফসল পর্যবেক্ষণ, কৃষি অ্যাপ্লিকেশন ও ব্লু-কার্বন ক্রেডিট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকূলীয় অর্থনীতিতে নবতর দিগন্ত উন্মোচন সম্ভব। বিশেষ করে গ্লোবাল ক্লাইমেট ফান্ড, আইএফএডি, জিইএফ এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় তথ্যভিত্তিক পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ অঞ্চলে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
লেখক- মো: শাহীন হোসেন, সেক্টর স্পেশালিষ্ট (এগ্রিকালচার), জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, ব্র্যাক