প্রত্যাখ্যান থেকে প্রত্যয়: নিঃশব্দে লেখক হয়ে ওঠার যাত্রা
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ০৮:২৭ পিএম

লেখক রহমান মৃধা
প্রত্যাখ্যানের বেদনা অনেক সময় প্রত্যয়ের জন্ম দেয়। এই লেখাটি সেই যাত্রার গল্প, যেখানে এক ব্যক্তিগত অপমান হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। একজন স্কুলশিক্ষক, যিনি সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন, অবসরে এসে সেই শিক্ষকই আজ জীবনযুদ্ধে অসহায়। পেনশন নেই, সন্তান-সংসারও নেই। বেঁচে থাকার তাগিদে তাঁকে কাটাতে হচ্ছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। বিষয়টি আমাকে জানায় আমার এলাকার এক ছোট ভাই, কলেজ শিক্ষক জুলফিকার আলী। গুরুজনের এই করুণ পরিণতি আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করে।
তৎক্ষণাৎ আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি আবেগঘন পোস্ট করি—দুইজন আদর্শ শিক্ষক, কৃষ্ণগোপাল ভট্টাচার্য ও সাধন ভট্টাচার্য মহোদয়ের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই সেই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সাহায্যের পরিবর্তে আমার পোস্টটি বিদ্রূপের শিকার হয়। এক তরুণ মন্তব্য করেন—“আপনি তো বানানের জাহাজ! আপনার তো বাংলা বানানে সমস্যা আছে!”
দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার কারণে বাংলা বানানে দুর্বলতা ছিল, কিন্তু এমন কটাক্ষ মনের ভেতর একটা তীব্র অভিঘাত তৈরি করে। আমি তাকে বিনীতভাবে উত্তর দিই, নিজের দুর্বলতার কথা স্বীকার করি। সে আর কখনো ফিরে আসেনি, তবে আমি থেমে থাকিনি।
সেদিন থেকেই শুরু হয় আমার শব্দের ভ্রমণ। মোবাইলের ছোট্ট বোতামে আঙুল চালিয়ে ধীরে ধীরে বাংলা লেখার অভ্যাস গড়ে তুলি। সেই যাত্রা আজ এসে পৌঁছেছে এমন এক পর্যায়ে—যেখানে আমার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দেশের শীর্ষ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে। আমি বিশ্বাস করি, কেবল চেষ্টা, অধ্যবসায় আর সুশিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাই একজন মানুষকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে।
আমার এই লেখক-যাত্রা একা চলার গল্প নয়।
পথে পেয়েছি এমন অনেক সুহৃদ, যারা বিশ্বাস করেছেন— ভাষা ও অভিব্যক্তির শক্তি দিয়েই বদলে দেওয়া যায় জীবন, জাগিয়ে তোলা যায় সমাজ। কারও উষ্ণ উৎসাহ, কারও নিঃশব্দ সহমর্মিতা কিংবা কারও কণ্ঠে উচ্চারিত একটি কথাই হয়ে উঠেছে আমার এগিয়ে চলার প্রেরণা।
বিভিন্ন ছোট-বড় গণমাধ্যম আমার লেখাগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে, তা প্রতিটি বাক্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এই যাত্রার প্রতিটি বাঁকে যারা আড়ালেই থেকেছেন, কিন্তু আলো দেখিয়েছেন—তাদের প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা।
আমি রহমান মৃধা—একজন বিশ্বনাগরিক। আমার জন্ম মাগুরা জেলার নহাটা গ্রামে, আর বর্তমানে আমি সুইডেনের স্টকহোমের এক গ্রামে বসবাস করছি। আমার শিক্ষাজীবনের পরিধি বিস্তৃত বাংলাদেশ, সুইডেন, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, পর্তুগাল, উত্তর আমেরিকা এবং জাপানে। পেশাগত জীবনে আমি আন্তর্জাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে একজন পরিচালক ও পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।
পারিবারিক জীবনে আমি একজন বাবা, স্বামী, ভাই ও বন্ধু। আমার স্ত্রী মারিয়া বার্সেলো একজন সুইডিশ-স্প্যানিশ নাগরিক ও ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির একজন এনালিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের দুই সন্তান—জনাথান ও জেসিকা মৃধা—এলিট টেনিস জগতের সঙ্গে জড়িত, এবং তাদের গড়ে তোলা আমার জীবনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা নয়—সুশিক্ষাই হোক মানবজাতির প্রকৃত উপার্জন। এ জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী, চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ এবং মানবতা ও নৈতিকতার সংমিশ্রণ। এই ভাবনাগুলোই উঠে এসেছে আমার প্রতিটি লেখায়—যেখানে ‘লার্নিং বাই ডুইং’ ও ‘আর্নিং বাই লার্নিং’-এর বাস্তব প্রয়োগ ও দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।
চূড়ান্ত কথন: একটি প্রজন্মের জন্য বার্তা
২০১৭ সালে “বানানের জাহাজ” বলে যাকে উপহাস করা হয়েছিল, সেই মানুষটি আজ দ্য ডেইলি স্টারে কলাম লিখছে। এটি শুধু আমার নয়, একটি প্রজন্মের অভিযাত্রা। চারপাশে যখন আত্মবিশ্বাস হারানো তরুণেরা কেবল সুযোগের অভাবে থমকে থাকে, তখন এই গল্প বলে—সঠিক লক্ষ্য, লজ্জাকে শক্তিতে রূপান্তর এবং নিরলস চর্চাই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে।
প্রশ্নটা কেবল বাংলা লিখতে পারো কি না—তা নয়। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো- তুমি কি থেমে যাবে, নাকি প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেকে গড়ে তুলবে? আমরা যদি সত্যিই দীপ্ত প্রতিজ্ঞায় বলীয়ান হই, যদি শতভাগ আন্তরিকতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে চলি—সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুতি না ঘটিয়ে—তবে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
ভুল নিয়ে ভয় নয়, শেখা নিয়েই গর্ব
যেখান থেকে মানুষ বিদ্রূপ করে পেছনে ফেলে যায়, সেখান থেকেই আবার উঠে দাঁড়ানোই হলো প্রকৃত সাহসের পরিচয়। জ্ঞান কখনো দয়া চায় না, কিন্তু আগ্রহ আর চর্চার কাছে মাথা নত করে। আর সে কারণেই, যদি ইচ্ছেটা থাকে খাঁটি, তবে সীমাবদ্ধতা নয়—সাফল্যই শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়।
তোমার লেখার স্পর্শ হোক নিঃশব্দ বিপ্লবের হাতিয়ার—যা হতে পারে ফোনের কীবোর্ডে আঙুলের ছোঁয়া, বা হৃদয়ে গেঁথে রাখা শব্দে—যা বদলে দিতে পারে তোমাকে, আর একদিন জাগিয়ে তুলতে পারে একটি প্রজন্মের সম্ভাবনা। নিজের গল্প নিজেই লিখে ফেলো—পাছে কেউ তোমার হয়ে তা বিকৃত করে।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]