×

প্রবাস

শিক্ষা-দুর্নীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি: আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু…

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৭ পিএম

শিক্ষা-দুর্নীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি: আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু…

শিক্ষা-দুর্নীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি

একটি দুর্ঘটনা ঘটতে দেখেছিলাম—আমি তা ঠেকাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। সে দুর্ঘটনাটি ছিল না কোনো সড়ক দুর্ঘটনা, কিংবা হঠাৎ কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এটি ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের জমে থাকা এক ভয়ঙ্কর ক্যানসারের বিস্ফোরণ, যেখানে স্বচ্ছতা ছিল অনুপস্থিত, আর ন্যায়ের কাছে চেয়ে থাকা চোখগুলো ছিল অবহেলিত। এক সময় যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান নিজেই আমাকে বলেছিলেন, “ভাই, দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। আপনি চেষ্টা করতে পারেন, তবে সফল হবেন না।” আমি তাঁকে বলেছিলাম, “আপনি পাশে থাকুন, আমি চেষ্টা করি। দেখা যাক কী ঘটে।” তিনি কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে কথা রাখতে পারেননি। এবং আজ আমি বুঝি, তিনি তখনই বলে দিয়েছিলেন আসল সত্যটি—এই ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি।

আমরা প্রায়ই শুনি, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। অথচ সেই মেরুদণ্ডেই আজ ঘা—পুঁজে ভরা ঘা। এই দুর্নীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি অদৃশ্য, কিন্তু অতীব শক্তিশালী গোষ্ঠী। জানেন কারা তারা? রাজনীতিবিদেরা। এরা এই ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে রসুনের মতো গেঁথে আছে—পৃথক শরীরে, কিন্তু একসঙ্গে গাঁথা। তাই একজন চলে গেলে আরেকজন আসে। এক দুর্নীতিবাজ নেতার জায়গা নেয় আরেক চাটুকার। কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে। 

নহাটা গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি পদে এক নিছক নিয়োগ প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই অনিয়ম থামাতে গিয়ে আমি যা দেখলাম, তা ছিল বিস্ময়কর, আতঙ্কজনক এবং অবিশ্বাস্য। আমি যোগাযোগ করেছিলাম মাগুরা জেলার ডিসি, বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে। বিশেষ করে কথা বলেছিলাম এলাকার তিনজন রাজনীতিকের সঙ্গে—নিতাই রায় চৌধুরী, কাজি কামাল এবং রবিউল ইসলাম নয়ন। তিনজনেই ভদ্র, মিষ্টভাষী, আশ্বাসদাতা। তারা আমাকে বলেছিল: “আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা দেখছি।” কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।

তবুও আমি বলবো—তারা খারাপ মানুষ না, কিন্তু এ দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন এমন নেতা, যারা কথা রাখে, ভয় পায় না, এবং চ্যালেঞ্জ নেয়। হয়তো কেউ বলবেন, “এটা তো পুরনো ঘটনা। এখন আবার কেন?” হয়তো কেউ বলবেন, “দেশের বারোটা তো আগেই বাজে গেছে, এখন এক স্কুলের সভাপতির নিয়োগ নিয়ে এত প্যাঁচাল কেন?” আমি বলি, হ্যাঁ, হয়তো একটা বিন্দু। কিন্তু সিন্ধু তো বিন্দু থেকেই জন্মায়।

বাংলাদেশে দুর্নীতির সংস্কৃতি গর্তের মতো—একবার পা পড়লে আর উঠতে পারা যায় না। শিক্ষা খাত যদি রক্ষিত না থাকে, তাহলে ভোট, গণতন্ত্র, বিচার—সবই প্রশ্নবিদ্ধ। আজ ৫ আগস্ট, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার আদায়ের দিন। কিন্তু এই দিনে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি—গত এক বছরে দুর্নীতি, লুটপাট, ধর্ষণ, খুন, গুম—সবকিছু যেন অতীতকেও হার মানিয়েছে।

আমরা এক ভয়ঙ্কর নির্বাচন-প্রহসনের দিকে এগোচ্ছি। কারা দায়িত্ব নেবে? কে দেবে সুস্থ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি? যেদেশের শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, সেখানে কীভাবে আশা করবো রাজনীতিবিদদের হাত থেকে মুক্ত একটি নির্বাচন?

একদিকে পেস্ট, অন্যদিকে কলেরা—তবে পছন্দ করতে তো হবেই। এখন সেই তিনজন রাজনীতিবিদের কথা ভাবুন—যাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম, এবং যারা কথা রাখেনি। তারেক রহমানের মতো একজন নেতৃত্বকে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কাকে রেখে কাকে সমর্থন করবেন?

এই একটি আসনের কথাই বলছি। দেশের ৬৪টি জেলা এবং দুটি করে আসন মিলিয়ে ১২৮টি স্থান। তার উপর মহিলা আসনও আছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ সহজ নয়। আমি উদাহরণ হিসাবে একটি দলের কথা উল্লেখ করলাম- ভাবুন অন্য দলের কথাও! আমার উপদেশ—জাগো বাংলাদেশ, জাগো! এই ডাক আজ আবেগ নয়, দায়িত্ব। এই সময় আর কাঁদার নয়, দাঁড়ানোর। অন্যায়ের সঙ্গে আপস নয়, মুখোমুখি সাহসের সংঘর্ষ চাই এখন।

বাংলাদেশ আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে একদিকে অন্ধকার, অন্যদিকে প্রতিশ্রুতি। মাঝখানে একটিই দরজা—সিদ্ধান্ত। আমরা যারা নিজেদের সৃজনশীল ও শিক্ষিত বা প্রতিবাদ করার মতো বিবেকবান মনে করি, তারা যদি চুপ থাকি—তাহলে ভবিষ্যৎ পাবে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর দাসত্ব। আপনার আশেপাশেই হয়তো অন্যায় ঘটছে—তুমিও প্রতিবাদ করতে পারো। শুধু লেখক, সাংবাদিক বা রাজনৈতিক কর্মী না—একজন শিক্ষক, একজন শিক্ষার্থী, একজন চাকরিজীবী এমনকি একজন অভিভাবকও হতে পারেন পরিবর্তনের অগ্রনায়ক।

আপনি কী করতে পারেন, আজ থেকেই:

১. ভোট দিন। নিজে ভোট দিন, অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করুন।

২. অনিয়ম দেখলে রিপোর্ট করুন। থেমে যাবেন না।

৩. সোশ্যাল মিডিয়ায় বা বন্ধুদের মাঝে সাহসের ভাষা বলুন।

৪. ভয় পাবেন না। যে ভয় পায় না, সেই-ই নেতা হয়।

৫. আপনিই আলোর মশাল। নতুন প্রজন্মের চোখে আপনি হয় আশা, নয় অন্ধকার।

আমি একটি সুইডিশ প্রবাদ দিয়ে শেষ করতে চাই— “Beslut måste tas även detta är obehagligt” বাংলায় অর্থ: “সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যদিও এটা অস্বস্তিকর”। এটা কোনো বেপরোয়া আহ্বান নয়, এটি নৈতিক সাহসের আহ্বান। যেখানে আইন দুর্নীতিগ্রস্ত, সেখানে বিবেকই শেষ সত্য। তোমরা যারা আগামী প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিতে চাও, শুনে রাখো—সত্যের পাশে দাঁড়াতে সাহস লাগে, এবং সাহসই একমাত্র মুদ্রা যা রাজনীতিকে পবিত্র করতে পারে। নেতা সেই, যে শোনে না কারা কী বলবে—শুধু জানে কী ঠিক আর কী ভুল।

হ্যাঁ, আজকের ঘটনাটি হয়তো অনেকের কাছে সামান্য, এক ফোঁটার মতো। কিন্তু ইতিহাস বলে—জোয়ার এক ফোঁটা জল থেকেই শুরু হয়। আমার চেষ্টা হয়তো ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমি মাথা নিচু করিনি। নীতিকে বিসর্জন দিইনি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন গড়ে তুলবে তারা, যারা ভয়কে পরোয়া করে না, যারা প্রশ্ন করতে জানে, এবং যারা “না” বলতে ভয় পায় না। এই লেখাটি কেবল একটি স্মৃতিকথা নয়—এটি প্রতিরোধের আগুনে জ্বলে ওঠা এক জ্বলন্ত দলিল।

রহমান মৃধা, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সিরিজে সমতায় ফিরলো টাইগাররা

শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সিরিজে সমতায় ফিরলো টাইগাররা

জরুরি ভিত্তিতে শতাধিক কর্মী নিচ্ছে ইউএস-বাংলার আইটি কোম্পানি

জরুরি ভিত্তিতে শতাধিক কর্মী নিচ্ছে ইউএস-বাংলার আইটি কোম্পানি

শিক্ষা-দুর্নীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি: আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু…

শিক্ষা-দুর্নীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি: আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু…

স্বৈরাচারমুক্তির শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না: আমিনুল হক

স্বৈরাচারমুক্তির শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না: আমিনুল হক

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App