×

মুক্তচিন্তা

শান্তি চাই পাহাড়ি জনপদে

Icon

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৬ পিএম

শান্তি চাই পাহাড়ি জনপদে

শান্তি হোক পাহাড়ি জনপদ। খাগড়াছড়ির দুর্গম জনপদ লম্বাছড়া গ্রাম।

শান্তির প্রতীক হয়ে ওঠার কথা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বহুমাত্রিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন এই জনপদকে সবসময়ই আলাদা করেছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো—এ অঞ্চল বারবারই রক্তপাত, সংঘাত আর সহিংসতার সাক্ষী হয়ে উঠছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে যে সহিংসতা দেখা গেল, তা আবারও আমাদের সামনে প্রশ্ন তুলে ধরেছে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায় হলো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা এবং আস্থার সেতু নির্মাণ করা। যেখানে প্রতিটি পাহাড়ি মানুষ নিজেকে নিরাপদ ও মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে অনুভব করবে।

খাগড়াছড়িতে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার পর থেকেই পাহাড়ি জনপদ আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। গত শনিবার জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে ডাকা সড়ক অবরোধকে ঘিরে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ, পাল্টা ধাওয়া–পাল্টাধাওয়ার ঘটনা, এমনকি গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি সহিংসতায় গড়ায়। এতে তিন পাহাড়ি নিহত হন। আহত হন সেনাসদস্য, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষসহ অন্তত ডজনখানেক ব্যক্তি। সহিংসতার রেশ এখনো কাটেনি, প্রশাসন খাগড়াছড়ি সদরে ১৪৪ ধারা জারি রেখেছে।

এই ঘটনাকে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘাত হিসেবে দেখা ভুল হবে। এর ভেতরে রয়েছে বাঙালি বনাম পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস, রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা।

আমরা দেখেছি, ধর্ষণের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর স্থানীয় সংগঠনগুলো সড়ক অবরোধের ডাক দেয়। এটি ছিল ন্যায়বিচারের দাবি জানানোর একটি প্রচলিত কৌশল। কিন্তু যখন সড়ক অবরোধ দিনভর চলতে থাকে, তখন সাধারণ মানুষের চলাচল ব্যাহত হয়, জরুরি সেবাও ব্যাহত হয়। সবশেষে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। বিশেষ করে গুইমারার রামেশু বাজারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, দোকানপাট ও বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা—এসবই স্পষ্ট করে দেয় যে পরিস্থিতি কেবল ন্যায়বিচারের দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাতে ঢুকে পড়েছে সহিংসতার উপাদান। যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

এই মুহূর্তে আমরা একটি বিন্দুর মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কীভাবে এ সংকটে উত্তরণ হবে। আমার বিশ্বাস — সংঘাতের দিকে না গিয়ে সংলাপে সমাধান বের হবে। স্থানীয় প্রশাসন, আন্দোলনকারী সংগঠন, সমাজকর্মী, শান্তিচিন্তক, নারী সংগঠন — সবাই মিলে একটি শান্তি-কমিটি গড়ে তোলা যেতে পারে। আলোচ্য তালিকায়টি হবে বিচার প্রক্রিয়া, নিরাপত্তা গ্যারান্টি, পুনর্বাসন, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এখানে সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের দাবিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সংলাপের পথে এগিয়ে যাওয়া।

এই ঘটনার আরেকটি দিক হলো পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তা প্রশ্ন। ধর্ষণ কিংবা যৌন সহিংসতার ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন কিছু নয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা অভিযোগ গোপন রাখে, মামলার দীর্ঘসূত্রিতাও একটি সমস্যা। ফলে সমাজে একটি বার্তা যায়—নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। ধর্ষণের অভিযোগের দ্রুত তদন্ত, স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া এবং ভুক্তভোগীর পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।

সাথে সাথে পাহাড়ি জনপদে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তির প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমে থাকলেই হবে না তা বাস্তবায়ন জরুরী। স্থানীয় মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ি ও সমতলের মধ্যে ভেদরেখা টেনে রাখলে সমস্যার সমাধান হবে না। সবাইকে সমান নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা দিতে হবে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন পাহাড়ি সংগঠন শান্তির আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদ ও মারমা উন্নয়ন সংসদ সাধারণ মানুষকে সহিংসতা থেকে দূরে থাকতে বলেছে। এটি ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় যে স্থানীয় জনগণ সহিংসতা চায় না। তারা চায় ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা। সুতরাং সরকার ও প্রশাসনেরও উচিত হবে এই আহ্বানকে গুরুত্ব দেওয়া এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।

সর্বশেষ, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা—সে পাহাড়ি হোক কিংবা সমতলের, সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু। খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক সহিংসতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই দায়িত্বে অবহেলা করলে তার মূল্য চোকাতে হয় নিরীহ মানুষের রক্ত দিয়ে। আমরা আর এমন দৃশ্য আর দেখতে চাই না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের শেখায় পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায় শত প্রতিকূলতার মাঝেও পাশাপাশি বসবাস করে এসেছে। কিন্তু অবিশ্বাস, বৈষম্য ও রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানিতে সম্পর্কের ফাটল বারবার গভীর হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো এই জনপদে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই পারস্পরিক সহাবস্থান ও সহযোগিতার বাইরে। পাহাড়ি ও বাঙালি উভয়কেই বুঝতে হবে, একে অপরকে বাদ দিয়ে নয়, একসঙ্গে চললে নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। পাহাড়ি জনপদে শান্তি ফিরিয়ে আনা শুধু স্থানীয়দের জন্য নয়, পুরো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।

লেখক: সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

অপরাধ প্রসঙ্গে বিবিসির সাক্ষাৎকারে যা বললেন শেখ হাসিনা

অপরাধ প্রসঙ্গে বিবিসির সাক্ষাৎকারে যা বললেন শেখ হাসিনা

‘বিএনপি-জামায়াত এক চামচ করে পেয়েছে, জনগণের প্লেট খালি’

‘বিএনপি-জামায়াত এক চামচ করে পেয়েছে, জনগণের প্লেট খালি’

নির্বাচিত সরকার এলে সব সমস্যার সমাধান হবে : আমীর খসরু

নির্বাচিত সরকার এলে সব সমস্যার সমাধান হবে : আমীর খসরু

‘সরকারের কাছে ৮ দলের তিন দাবি’

‘সরকারের কাছে ৮ দলের তিন দাবি’

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App