সাক্ষাৎকার : অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়নি

ঝর্ণা মনি
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ড. হারুন অর রশিদ
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণের পথেই বাংলাদেশের উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- এমন মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ। তবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অর্থনৈতিক মুক্তির পথে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেলেও সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়নি বলে মনে করেন তিনি।
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সব লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলা যাবে না। শুধু সফলতা নয়, ব্যর্থতাও রয়েছে। বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। দুর্নীতি দমনে আমরা সফল হতে পারিনি। এখনো এই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। শোকের মাস আগস্ট উপলক্ষে গতকাল বুধবার ভোরের কাগজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, আদর্শ এবং আজকের বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
ড. হারুন অর রশিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত; উন্নত সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ- যা এককথায় সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সমাজের সবস্তরের মানুষের কল্যাণের পাশাপাশি যারা অসহায় এবং যুগ যুগ ধরে শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্চিত- সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও উন্নতি সাধন। এর মধ্য দিয়ে সুখী সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। সেই স্বপ্নপূরণে ১৯৭২ সালে দেশে ফিরেই দেশ গঠন শুরু করেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুনর্গঠন, পুনর্বাসন করেন। এরপর স্বপ্নপূরণের জন্য এক এক করে পদক্ষেপ নিলেন। কিন্তু তিনি সময় পাননি। বঙ্গবন্ধু যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তিনি যদি আরো কিছু সময় পেতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর আমলেই সোনার বাংলাদেশ গড়ার দোরগড়ায় পৌঁছে যেত বাংলাদেশ। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর সবকিছু পাল্টে যায়। এরপর বিভিন্ন মেয়াদে ২৭ বছর দেশের ভেতরে যে রাজনৈতিক দলগুলোর শাসন ছিল, তারা দেশকে ভিন্ন পথে নিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জলাঞ্জলি দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে সমাজে পুনর্বাসিত করেছে।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে দেশ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের পথে ঘুরে দাঁড়ায়। বর্তমানে শেখ হাসিনার টানা শাসনামলে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করছেন তার কন্যা। তার পথই অনুসরণ করছেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিটি থানায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপন করেছিলেন, ওই ধারণা থেকেই কমিউনিটি হাসপাতাল করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বঙ্গবন্ধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করেছেন। শেখ হাসিনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু নারী শিক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছেন, এখন শেখ হাসিনার আমলে নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, সেখানে চরম দারিদ্র্যের হার ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ, আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু সরকারি খরচে বই ছাপিয়ে বিতরণ করেছেন। আজ তা প্রসারিত হয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো, আজ সারাদেশে বিদ্যুৎ, এখানে প্রধানমন্ত্রী শতভাগ সফল। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাঙালি জাতি মর্যাদার সঙ্গে বাঁচুক। আজ বিশ্ব দরবার ক্ষুধা-দারিদ্র্য, বৈশ্বিক সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ নয়, আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন সারা বিশ্বের বিস্ময়।
অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছেন মাত্র ৩ বছর ৭ মাস। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চিন্তা চেতনা উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে ধারণ করেই পথ চলছেন। এ কারণেই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেন, বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য কাজ, আদর্শ নিয়েই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চেয়েছেন; কিন্তু এখনো দুর্নীতিমুক্ত হয়নি। আরো বেড়েছে। এক্ষেত্রে সফলতা অর্জিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সুখী সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতাকারী, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এই রাজনৈতিক দলগুলোর অব্যাহত ষড়যন্ত্রের কারণে দেশে রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ছে, সহিংসতা বাড়ছে।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিচ্যুতি ঘটেছে মন্তব্য করে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, সময়ের পরিসরে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের রাজনীতি, দেশ জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করা দেশপ্রেমের রাজনীতি থেকে অনেক পিছিয়ে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত, তাদের মধ্যেও বহু ক্ষেত্রে, বহু স্তরে নেতানেত্রীর মধ্যে বিচ্যুতি ঘটেছে। এর একটি নেতিবাচক প্রভাব দলের মধ্যে, সমাজের মধ্যে এবং রাজনীতির মধ্যে পড়েছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিশ্বাস করলে ঘুষ, দুর্নীতি, জুলুম করতে পারে না। সম্পদ, বিত্ত-বৈভবের পেছনে দৌড়াতে পারে না। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যারা নেতৃত্বস্থানীয় রয়েছে তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্দেশ্য করার জন্য ও দলভারি করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শচ্যুত হয়ে কার্যত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পরিপন্থি কাজ করছে। শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের রাজনীতির আদর্শে দীক্ষিত হয়ে শেখ হাসিনার উন্নয়নে সহযোগী হওয়ার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ।