টিসিবির পণ্য
ট্রাকের পেছনে অপেক্ষার প্রহর, মুখ ঢেকে দাঁড়ান মধ্যবিত্তরাও

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:১৬ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য সরবরাহ ও বিক্রয় কেন্দ্রগুলোর সামনে অপেক্ষমাণ মানুষের সারি। সরবরাহ দ্বিগুণ করেও পণ্য কিনতে আসা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না সংস্থাটি। প্রতিদিনই ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর খালি হাতে ফিরছে অনেক মানুষ। পণ্য না পেয়ে হতাশ হয়ে রাস্তায় বসে পড়তেও দেখা যায় কাউকে কাউকে। এরই মধ্যে আবার পণ্য অবৈধভাবে গুদামজাত ও বিক্রয়ের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।
দুই মাসের বিরতি দিয়ে গত ১০ আগস্ট থেকে আবারো টিসিবির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির নিত্যপণ্য পেতে এবারের লাইনে নিম্নবিত্তদের পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও। এমনকি বিভিন্ন কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও এখন সাশ্রয়ী পণ্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। এ দৃশ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন খুবই স্বাভাবিক। টিসিবি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাকসেলে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও আলোচনা চলছে।
এদিকে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে টিসিবির ট্রাকসেলে স্বল্পমূল্যে পণ্য কিনতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, আগস্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ের তুলনায় কিছুটা কমেছে। তবে অস্বস্তি রয়ে গেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে। এক মাসের ব্যবধানে কমার এ হিসাব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দিলেও সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের বাজারে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে। কারণ, কাগজে কলমে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও ব্যয়ের চাপ তেমন কমেনি। সাধারণ মানুষের চাওয়া একটাই, আয়-ব্যয়ের হিসাব যেন সহজে মেলাতে পারেন। এজন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। আর তা সহজ করতে মূল্যস্ফীতির হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এদিকে, টানা ৪৩ মাস ধরেই মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে পিছিয়ে আছে, যা নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মজুরি না বাড়লে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন নিম্নবিত্তরা।
টিসিবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে বাজারে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ১১ সেপ্টেম্বরের আগের বছরের একই সময়ের বাজারদরের তুলনায় ৫৪টি পণ্যের মধ্যে ৩৪টির দাম বেড়েছে। বিশেষ করে চাল, আটা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, মাছ ও মাংসের দাম বেড়েছে, যা পরিবারের দৈনন্দিন খরচে বড় অংশজুড়ে। কিছু পণ্য প্রায় ৫০ শতাংশ দাম বেড়েছে। সরকারি উদ্যোগে টিসিবি আগস্ট মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে নিত্যপণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রতি ট্রাক থেকে প্রতিদিন ৫০০ মানুষকে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল এবং চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। জনপ্রতি ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই লিটার তেল, দুই কেজি ডাল এবং এক কেজি চিনি কিনতে পারছেন। টিসিবি জানিয়েছে, ঢাকা মহানগরীতে ৬০টি ট্রাকে ১০ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পণ্য বিক্রি চলবে। দেশের অন্যান্য জেলার জন্যও নির্দিষ্ট স্থানে ১০ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিক্রয় কার্যক্রম চলেছে। ৫৪ লাখ পরিবার বর্তমানে সক্রিয় স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে এ সুবিধা পেতে পারবে।
জানা গেছে, সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো স্বল্প আয়ের মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টিসিবি পণ্য বিক্রি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। তবে এই পণ্য বিক্রি কার্যক্রমে রাজধানীর আশপাশের এলাকায় যা দেখা গেছে, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। অনেকেই দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য কিনতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন। আবার পূর্বঘোষিত স্থানে নির্ধারিত সময়ের পরে ট্রাক আসায় পণ্য কেনার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যাচ্ছে। দুর্বল ও বয়স্ক ব্যক্তিরা এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পণ্য কিনতে ব্যর্থ হন। নির্ধারিত স্থানে টিসিবির ট্রাক কখন আসবে জানেন না অনেকে। তারপরও সকাল থেকে রাস্তার ধারে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এতে পণ্য কিনতে যাওয়া মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হলেও তা সহ্য করছেন। এরপরও সুলভে পণ্য কিনতে আসা নিম্ন আয়ের মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না টিসিবি। দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষার পর খালি হাতেই ফিরছেন অনেকে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবির ডিলার মেসার্স ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ ট্রাকে পণ্য বিক্রি করে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে। দেখা গেছে, মানুষের সারি নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে মূল সড়ক পর্যন্ত পৌঁছেছে। দুপুর ৩টার পর পণ্য শেষ হয়ে যাওয়ায় ফিরে যায় ট্রাকটি। কিন্তু পণ্য না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে ষাটোর্ধ্ব আছিয়া বেগমকে। তিনি বলেন, সকাল থেকে লাইনে ছিলাম। কিন্তু কিনতে পারিনি। কাল আবার দাঁড়াব। লাইনে দাঁড়ানো আনোয়ার হোসেন বলেন, টিসিবির পণ্যগুলো কম দামে দেয়ায় সাধারণ মানুষ বেশি ভিড় করেন। বাজারে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি; এ কারণে মানুষ এখানে ভিড় করেন। অনেকে সকাল থেকে শুধু অপেক্ষা করেন কখন ট্রাক আসবে। সবাই পণ্য পান না।
রাজধানীর প্রেস ক্লাব এলাকার ট্রাকের লাইন থেকে টিসিবির পণ্য কিনতে না পেরে খালি হাতে ফিরেছেন গুলিস্তানের কাপড় দোকানি মো. রুবেল হোসেন। তিনি বলেন, পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকি। দুই ছেলেমেয়ের পড়ালেখা এবং বাসা ভাড়া ও খাওয়া খরচ মিলিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। দোকানেও বেচাকেনা কিছুটা কমেছে। এ শীতের দিনে ভেবেছিলাম বেচাকেনা বাড়বে। কিন্তু মানুষ পণ্যের কেনা দামই বলে না। ফলে দোকান ভাড়া দিয়ে খুব বেশি থাকে না। আমি এর আগে কখনো টিসিবির লাইনে দাঁড়াইনি। গত মাসে একবার এসেছি আর আজ এলাম। গত মাসে কিনতে পারলেও আজ ভিড় ঠেলে কিনতে পারিনি। ট্রাক চলে গেছে, পণ্য শেষ।
মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে টিসিবির ট্রাকের এক ক্রেতা আকলিমা আক্তার বলেন, পণ্য পেয়েছি। কিন্তু অনেক কষ্টে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও যার পরিচিত আছে সে আগে নিয়ে যায়। অথচ সে লাইনে দাঁড়ায়নি। রনি হোসাইন নামে এক যুবক বলেন, দিন দিন যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে; তাতে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা মুশকিল। টিসিবির পণ্য তবুও মানুষের মধ্যে একটু স্বস্তি দিতে পেরেছে। তবে ক্রেতার সংখ্যা বেশি, পণ্য সীমিত। টিসিবি যদি পণ্য দেয়ার পরিমাণ বাড়ায় তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য আরো ভালো হয়; সবারই পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে।
মৌচাক মোড়ে বাজারে পণ্য নিতে আসা আমিনুল হক বলেন, পণ্য নিতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। তিনি বলেন, পণ্য দেয়ার পরিমাণ বাড়ালে সাধারণ মানুষের আরো উপকার হতো। পণ্য না পেয়ে যারা ফিরে যাচ্ছেন তাদের তো দিনের কাজ কোনোটাই ঠিকমতো হয় না। আবার তারা পণ্য না নিয়ে ঘরে ফিরছেন হতাশ হয়ে।
মালিবাগ রেলগেট এলাকার গৃহিণী মিনু আরা খাতুন বলেন, বাজার থেকে দুই লিটার তেল কিনতেই প্রায় ৪০০ টাকা লাগে। এখানে মাত্র ৪৫০ টাকায় দুই লিটার তেল, দুই কেজি ডাল ও চিনি পাচ্ছি। তিনি বলেন, কিছু টাকা বাঁচানোর জন্যই দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করে হলেও এসব পণ্য কিনে নিচ্ছি। লাইনে দাঁড়ানো আব্দুস সালাম বলেন, কিছু টাকা বেঁচে যায়, যার কারণে গরমের মধ্যে কষ্ট হলেও লাইনে দাঁড়িয়েছি। এরই মধ্যে বাজারে পেঁয়াজ ও আটার দামও বেড়ে গেছে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ তেল, ডাল, চিনির সঙ্গে পেঁয়াজ ও আটাও যেন সাশ্রয়ী দামে দেয়া হয়।
পণ্য সংকট ও খালি হাতে নিম্ন আয়ের মানুষের ফিরে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবির উপপরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি প্রতিটি এলাকার গরিব মানুষ যাতে পণ্য পায়। এজন্য প্রতিদিন স্থান পরিবর্তন করা হয়। আমরা ধাপে ধাপে সংখ্যা বাড়িয়েছি। এখন প্রতিটি ট্রাকে ৫০০ জনের জন্য পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। পুরো ঢাকায় ৫০টি ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সামর্থ্যরে সবটুকু চেষ্টা করছি, যেন কেউ খালি হাতে ফিরে না যায়। আশা করি আগামীতে চাহিদা বিবেচনায় এ সংখ্যা আরো বাড়াতে পারব। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমরা জানিয়েছি। শাহাদাত হোসেন আরো বলেন, বাজারে কঠোর মনিটরিং করা হচ্ছে। সাধারণ ক্রেতাদের পণ্য না দিয়ে কোনো ডিলার অবৈধভাবে মজুত করলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হবে। একই সঙ্গে তার ডিলারশিপও বাতিল করা হবে। এছাড়া মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি তদারকি করছেন।