×

অর্থনীতি

চীনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন: বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত

মিজানুর রহমান সোহেল

মিজানুর রহমান সোহেল

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫, ০৫:৩৫ পিএম

চীনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন: বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত

চীনের প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতি। ছবি: ভোরের কাগজ

২০১৭ সালে আমি বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক যুগান্তরে অনলাইন বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করি। তখন ডিজিটাল সাংবাদিকতা বাংলাদেশের জন্য ছিল এক নবজাগরণের সময়। সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসে চীন সরকারের আমন্ত্রণে চীনের ইউনান ইউনিভার্সিটিতে সফরে যাই। সেই ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগে গিয়ে দেখি চীনা শিক্ষার্থীরা চমৎকার বাংলায় কথা বলছেন। খাঁটি বাংলা উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি সমকালীন রাজনীতি নিয়ে তারা কথা বলছেন। আমাদের সম্মানে তারা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতসহ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনালেন। সেখানেই চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল (সিআরআই)-এর বাংলা বিভাগের কিছু সংবাদকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। তারা কীভাবে বাংলাদেশের জন্য প্রতিদিন সংবাদ তৈরি করেন, কীভাবে শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখান এবং বাংলা ভাষা নিয়ে তাদের আবেগ, ভালোবাসা ও আগ্রহ দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। তাদের কাজে যে নিষ্ঠা, সেই সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবহারের যে দক্ষতা, তা তখনই বুঝিয়ে দিয়েছিল, চীনের সাংবাদিকতা প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।

এরপর ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে চীনের বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের আমন্ত্রণে সাংহাইতে অনুষ্ঠিত এক গ্লোবাল প্রেস কনফারেন্সে তথ্যপ্রযুক্তির ‘ফ্রন্টিয়ার’ সরাসরি দেখার সুযোগ পাই। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। এরপর হুয়াওয়ের সেনজেন ও গুয়াংজুতে অবস্থিত ফ্যাক্টরি, অফিস ও রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার পরিদর্শনের সুযোগ পাই। সেখানেই আমি প্রথম উপলব্ধি করি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ফাইভজি এবং স্মার্ট প্রযুক্তি কিভাবে চীনের সংবাদ ও যোগাযোগ খাতকে আমূল পরিবর্তন করছে। হুয়াওয়ের ল্যাবগুলোতে প্রবেশ করতেই দেখলাম ফাইভজি টেস্টবেড, রোবোটিক অ্যাসেম্বলি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মতো অত্যাধুনিক উদ্ভাবন। এডভান্সড সাইবার সিকিউরিটি প্রযুক্তি, নতুন ধরনের হাইপারফাস্ট নেটওয়ার্ক, মেশিন ভিশন এবং স্পিচ-টু-টেক্সট পাইপলাইন সব মিলিয়ে ভবিষ্যতের নিউজরুমের একটি সম্পূর্ণ ব্লুপ্রিন্ট যেন আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হলো। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে জানান দিয়েছিল, চীন কেবল প্রযুক্তি উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নয়, তথ্যপ্রবাহ ও সাংবাদিকতার জগতেও তারা বিশ্বনেতা হয়ে উঠছে। নিশ্চিত ছিলাম, গণমাধ্যমের পরবর্তী অধ্যায় হবে সম্পূর্ণ প্রযুক্তি-চালিত, ডাটা-নির্ভর এবং ব্যবহারকারী-কেন্দ্রিক। আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী আর কেবল একটি ধারণা নয়; এটি একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এই বাস্তবতার প্রমাণ কী? চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন লেখক 

চীনের এআই বিপ্লব: ৬১.১% এআই পেটেন্ট চীনের

স্ট্যানফোর্ড এআই ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২৪ অনুযায়ী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) গবেষণায় চীন বর্তমানে বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের মোট এআই পেটেন্টের ৬১.১ শতাংশ চীনের নামে নিবন্ধিত, যা বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির মানচিত্রে চীনের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। এই পরিসংখ্যান কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি চীনের এআই গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ, উদ্ভাবন এবং দ্রুত অগ্রগতির এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। এই বিশাল অংশীদারিত্ব চীনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং বৈশ্বিক এআই ইকোসিস্টেমে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। গবেষণা, উদ্ভাবন এবং বাস্তব প্রয়োগ এই তিন অঙ্গনে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে শক্ত প্রতিযোগিতায় ফেলেছে। চীনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও টেক জায়ান্টগুলো যেমন ডিপসিক, বাইদু’স আর্নি বট, টেনসেন্ট হুন-ইউয়ান এবং আই-ফ্লাই-টেক স্পার্ক এখন বৈশ্বিক এআই প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী। বিশেষত ডিপসিক, যা মানুষের মতো প্রাকৃতিক ভাষায় কথা বলতে পারে, জটিল ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে, এমনকি সাংবাদিকতার রিপোর্টও তৈরি করতে সক্ষম। 

চীনে এআই ও সাংবাদিকতা: বদলে যাচ্ছে গল্প বলার ধরণ

চীনে এআই কেবল তথ্য বিশ্লেষণ বা নিউজ লেখা নয়, বরং সাংবাদিকতার পুরো ইকোসিস্টেমকে রূপান্তরিত করছে। আগে যেখানে সংবাদ তৈরি, যাচাই, সম্পাদনা এবং প্রকাশ ছিল সম্পূর্ণ মানবনির্ভর, সেখানে এখন এআই সাংবাদিকতার পুরো ইকোসিস্টেমকে পুনর্গঠন করছে-ডেটা সংগ্রহ থেকে গল্প বলার ধরন পর্যন্ত সবকিছুতে ঘটছে বিপ্লব। ডেটা জার্নালিজমের বিস্তারে এআই গভীরভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ বিগ ডেটা বিশ্লেষণ করে সংবাদযোগ্য তথ্য খুঁজে বের করা এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক সহজ। চীনের প্রযুক্তিনির্ভর সংবাদমাধ্যমগুলো এআই-নির্ভর ভিজ্যুয়ালাইজেশন ব্যবহার করে জটিল অর্থনীতি, নির্বাচন বা সামাজিক পরিসংখ্যানের গল্পগুলোকে ডেটা-চিত্র, চার্ট, হিটম্যাপ এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ গ্রাফিক্সের মাধ্যমে উপস্থাপন করছে। ফলে সংবাদের গভীরতা যেমন বাড়ছে, পাঠকের বোধগম্যতাও তত দ্রুত উন্নত হচ্ছে।

এআই সোশ্যাল মিডিয়া অ্যানালিটিক্সে বিপ্লব এনেছে। চীনের শীর্ষ মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এআই-ভিত্তিক সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস মডেল ব্যবহার করে পাঠকের প্রতিক্রিয়া, আবেগ এবং সামাজিক ট্রেন্ড গণনা করছে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো রাজনৈতিক ঘটনা বা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের অনুভূতি ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক এআই তা রিয়েল-টাইমে বিশ্লেষণ করছে। এতে সাংবাদিক ও সম্পাদকরা এখন কেবল সংবাদই তৈরি করছেন না, বরং ডেটা-ড্রিভেন কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজিও তৈরি করছেন। এছাড়া এআই সাংবাদিকের কাজের ধরনই বদলে দিয়েছে। আগের সাংবাদিকরা শুধু তথ্য সংগ্রহ ও লেখায় সীমাবদ্ধ ছিলেন, আর এখন তিনি হয়ে উঠছেন ডেটা ডিজাইনার, তিনি তথ্যকে ভিজ্যুয়াল ডেটায় রূপ দেন। সাংবাদিকরা এখন ডিজিটাল স্টোরিটেলার, যিনি কাহিনীকে মাল্টিমিডিয়া আকারে নির্মাণ করেন। একইসঙ্গে এই যুগের সাংবাদিকরা একজন অ্যালগোরিদমিক থিংকার, যিনি অটোমেশন ও এআই-জেনারেটেড ডেটার ব্যাখ্যা করেন। 

২০১৮ সালের অক্টোবরে চীনের সাংহাইয়ের এই অডিটরিয়ামে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ নেন লেখক

নিউজরুমে এআই: চীনেই প্রথম এআই সংবাদ অ্যাঙ্কর উন্মোচন 

চীনের এই অগ্রযাত্রার সবচেয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় সংবাদমাধ্যমে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া (Xinhua News Agency) ২০১৮ সালেই পৃথিবীর প্রথম এআই সংবাদ অ্যাঙ্কর উন্মোচন করে, যা একটি প্রতীকী মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই এআই অ্যাঙ্কর ২৪ ঘণ্টা বিরতিহীনভাবে সংবাদ উপস্থাপন করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, এটি প্রয়োজন অনুযায়ী টোন, ভিজ্যুয়াল এক্সপ্রেশন ও ভাষা পরিবর্তন করতে পারে। এর ফলে রাত-বিরাতের রুটিন বুলেটিন, আর্থিক বা আবহাওয়ার হালনাগাদ তথ্য কম খরচে এবং দ্রুততার সঙ্গে পরিবেশন করা সম্ভব হয়েছে।

সিনহুয়া এবং সিজিটিএন-এর মতো চীনের বড় গণমাধ্যমগুলো বর্তমানে ডেটা জার্নালিজম, রিয়েল-টাইম সামাজিক মাধ্যম পর্যবেক্ষণ এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ রিপোর্টিং এমনভাবে ব্যবহার করছে যেখানে মানুষ ও যন্ত্র একসঙ্গে সংবাদ তৈরি ও উপস্থাপন করছে। এসব গণমাধ্যমগুলো গত কয়েক বছরে একটি শক্তিশালী প্রযুক্তিগত কাঠামো (টেক স্ট্যাক) তৈরি করেছে, যা এআই-এর মাধ্যমে সংবাদ উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সুসংগঠিত করেছে। এই কাঠামোটি মূলত নিম্নলিখিত ধাপে কাজ করে:

তথ্য গ্রহণ: বিভিন্ন উৎস যেমন সংবাদ সংস্থা, সামাজিক মাধ্যম, সেন্সর এবং উন্মুক্ত ডেটা থেকে রিয়েল-টাইম তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

তথ্য বিন্যাস: প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ (এনএলপি) ব্যবহার করে বিষয়বস্তু, সত্তা, অনুভূতি এবং ঝুঁকির মাত্রা চিহ্নিত করা হয়।

স্বয়ংক্রিয়করণ: শেয়ারবাজার, আবহাওয়া বা খেলাধুলার মতো বিষয়গুলিতে টেমপ্লেট-ভিত্তিক লেখা তৈরি করা, দ্রুত ক্লিপিং এবং সাবটাইটেলিং করা হয়।

দৃশ্যমান উপস্থাপন: এআই-এর সাহায্যে চার্ট, মানচিত্র এবং অ্যানিমেটেড গ্রাফিক্স তৈরি করা হয়।

ব্যক্তিগতকরণ: পাঠকের আচরণ ডেটা বিশ্লেষণ করে বিষয়বস্তুর গুরুত্ব নির্ধারণ করা হয় কখন, কাকে, কোন বিন্যাসে কী দেখানো হবে তা নির্ধারণ করা হয়।

বিতরণ: বহু-প্ল্যাটফর্মে প্রকাশনা ও সময়সূচী নির্ধারণ, এ/বি টেস্টিং এবং সূক্ষ্ম টিউনিং করা হয়।

নিয়মকানুন মেনে চলা: বিষয়বস্তু নীতি, উৎসের নিরীক্ষা, মডেল লগইন/রোলব্যাক এবং লেবেলিং নিশ্চিত করা হয়।

উদ্ভাবনের ইকোসিস্টেম: বিশ্ব গণমাধ্যমকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যাচ্ছে চীন

চীনের এই গণমাধ্যম-প্রযুক্তি রূপান্তরের পেছনে একটি শক্তিশালী উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম কাজ করছে, যার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনটি। এক. সরকারি রোডম্যাপ ও ব্যক্তিগত মূলধন: নীতির নিশ্চয়তা, গবেষণা অনুদান, স্টার্টআপ এক্সিলারেটর এবং বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর গবেষণা ও উন্নয়নে একই দিকে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দেখা যায়। দুই. স্থানীয়করণকৃত এআই: বহুভাষিক এবং উপভাষিক সমর্থনে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় সংবাদ দ্রুত অনুবাদ করা, আঞ্চলিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং কণ্ঠস্বর ক্লোনিং সম্ভব হচ্ছে। এবং তিন. গভীর প্রযুক্তির মেধা পাইপলাইন: বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্পের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে কারিগরি নেতৃত্ব তৈরি করা হচ্ছে, যা এই অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করছে। এই সমস্ত উপাদানের সম্মিলিত প্রভাবে চীন বিশ্ব গণমাধ্যমকে একটি নতুন দিগন্তে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবাদের ভবিষ্যৎ নয়, বরং বর্তমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ে চীন-বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখক 

চীনা প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা

আধুনিক বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সাংবাদিকতাও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে চীনের দ্রুত বর্ধনশীল এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শিল্পে, এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও গভীর প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতাও এর থেকে বাদ যায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোকে এক নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রকাশনা এবং পাঠক পর্যন্ত পৌঁছানোর পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত সমাধান প্রায়শই ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোর উচ্চ মূল্যের প্রযুক্তির বিকল্প হিসেবে চীনা প্রযুক্তি একটি সাশ্রয়ী এবং কার্যকর সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। টেলিযোগাযোগ, ডিজিটাল অবকাঠামো, এআই এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো ক্ষেত্রগুলোতে চীনের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। চীনা কোম্পানিগুলো শুধু পণ্য সরবরাহ করছে না, বরং স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টমাইজড সমাধানও দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

সংবাদ সংগ্রহ ও রিপোর্টিংয়ে পরিবর্তন

বাংলাদেশের অনেক সংবাদমাধ্যম এখন চীনা ড্রোন প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করছে দুর্গম এলাকায় সংবাদ সংগ্রহ বা বড় ইভেন্টের চিত্র ধারণের জন্য। উদাহরণস্বরূপ, বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যখন প্রচলিত পরিবহন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে, তখন ড্রোন ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বিস্তারিত চিত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এটি শুধু সময়ই বাঁচায় না, বরং সাংবাদিকদের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণও। ডিজেআই-এর মতো চীনা ব্র্যান্ডের ড্রোনগুলো বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও মোবাইল জার্নালিজম (মোজো) এখন বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। চীনা ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন, যেমন শাওমি, হুয়াওয়ে, ভিভো বা অপ্পো তাদের উন্নত ক্যামেরা এবং ভিডিও রেকর্ডিং ক্ষমতার কারণে সাংবাদিকদের কাছে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। এই ফোনগুলো ব্যবহার করে সাংবাদিকরা দ্রুত সংবাদ সংগ্রহ, ভিডিও এডিটিং এবং সরাসরি সম্প্রচার করতে পারছেন, যা আগে ব্যয়বহুল সরঞ্জাম ছাড়া সম্ভব ছিল না। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন রিপোর্টারও এখন প্রায় পেশাদার মানের সংবাদ তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেন।

প্রচার ও প্রকাশনা পদ্ধতিতে চীনা প্রযুক্তির প্রভাব

সংবাদ প্রকাশনার ক্ষেত্রেও চীনা প্রযুক্তির প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলাদেশের অনেক অনলাইন পোর্টাল এবং টেলিভিশন চ্যানেল তাদের ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নত করতে চীনা সার্ভার এবং নেটওয়ার্কিং সরঞ্জামের ওপর নির্ভর করছে। জেটটিই এবং হুয়াওয়ের মতো কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক অবকাঠামো তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যা দ্রুত ডেটা ট্রান্সফার এবং নিরবচ্ছিন্ন অনলাইন স্ট্রিমিং নিশ্চিত করে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেও চীনা প্রযুক্তির প্রভাব পরোক্ষভাবে দেখা যাচ্ছে। যদিও ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো পশ্চিমা, কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে কন্টেন্ট আপলোড করার জন্য শক্তিশালী ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন, যা অনেকাংশে চীনা প্রযুক্তির তৈরি অবকাঠামো দ্বারা সমর্থিত। এছাড়াও কিছু সংবাদমাধ্যম তাদের নিজস্ব অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট বা ওয়েবসাইট অপটিমাইজেশনের জন্য চীনা প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান ব্যবহার করছে, যা ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করছে।

এআই এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স সাংবাদিকতাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে এর ব্যবহার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে, তবে চীনা প্রযুক্তি এক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি এনে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্বয়ংক্রিয় সংবাদ তৈরি বা ডেটা-চালিত রিপোর্টিংয়ের জন্য চীনা এআই টুলস ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশাল ডেটাসেট বিশ্লেষণ করে ট্রেন্ড বের করা বা জনমতের পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কাজগুলো এআই-এর সাহায্যে আরও সহজ হবে, যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে আরও শক্তিশালী করবে। একটি উদাহরণ হতে পারে, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়ে জনগণের মনোভাব বুঝতে এআই-চালিত টুল ব্যবহার করা। বিভিন্ন অনলাইন উৎস থেকে ডেটা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে সাংবাদিকরা আরও নির্ভুল এবং প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবেন। যদিও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এখনো এই ধরনের প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়নি, তবে ভবিষ্যৎ এর সম্ভাবনা উন্মোচন হচ্ছে।

দৃষ্টিনন্দন ইউনান বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লেখক

চীনা প্রযুক্তি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ চীনা প্রযুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফাইভ-জি প্রযুক্তির আগমন এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করবে। হুয়াওয়ের মতো কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের ৫জি অবকাঠামো নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা অতি দ্রুত ডেটা ট্রান্সমিশন এবং হাই-ডেফিনিশন ভিডিও স্ট্রিমিংকে সম্ভব করবে। এর ফলে রিয়েল-টাইম রিপোর্টিং আরও সহজ এবং দক্ষ হয়ে উঠবে। অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) ব্যবহার করে সংবাদ পরিবেশনের নতুন ধারণাও বাস্তবে রূপ নিতে পারে, যা পাঠককে একটি নিমগ্ন অভিজ্ঞতা দেবে। তবে এই প্রযুক্তির সুবিধাগুলো সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানোর জন্য সাংবাদিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞান বাড়ানো জরুরি। 

চীনা প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতা সত্যিই এক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রকাশনা এবং দর্শকের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে এর প্রভাব সুস্পষ্ট। সাশ্রয়ী, কার্যকর এবং উদ্ভাবনী এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করছে। এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতিই নয়, এটি সংবাদমাধ্যমের জন্য নতুন সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসছে, যা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।

চীনের প্রযুক্তি উত্থান ও বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে প্রভাব: একটি বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা

চীনের প্রযুক্তি উত্থানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ সালের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতির মধ্য দিয়ে। তখন থেকেই দেশটি বুঝেছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে প্রযুক্তির ওপর। দুই দশকের মধ্যেই ‘মেড ইন চায়না’ থেকে ‘ডিজাইনড ইন চায়না’ এই রূপান্তরের পথে চীন যেভাবে এগিয়েছে, তা আজ বৈশ্বিক অর্থনীতির নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। চীনের প্রযুক্তিগত লাফিয়ে ওঠার কৌশল ছিল অনন্য। তারা প্রথমে পশ্চিমা প্রযুক্তি অনুকরণ করেছে, পরে তা নিজস্ব উদ্ভাবনের মাধ্যমে অতিক্রম করেছে। সেনজেন, সাংহাই, গুয়াংজু এসব শহর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠে, যেখানে প্রযুক্তি হস্তান্তর, বিদেশি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি ছিল নীতিগত অগ্রাধিকার। এই অঞ্চল থেকেই হুয়াওয়ে, টেনসেন্ট, আলিবাবা ও ডিজেআই-এর মতো বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান জন্ম নেয়।

চীনের সরকার পরবর্তীতে ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নীতির মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেমিকন্ডাক্টর, রোবোটিক্স ও বায়োটেকনোলজিকে জাতীয় অগ্রাধিকারে পরিণত করে। এর ফলেই আজ চীন বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলোর একটি। চীনের এই সাফল্য শুধুই গল্প নয়, পরিসংখ্যানে দৃশ্যমান এক বাস্তবতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চীন এখন বৈশ্বিক নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত গবেষণাপত্রের উল্লেখযোগ্য অংশই আসে সেখান থেকে। হুয়াওয়ে ইতিমধ্যেই ষাটেরও বেশি দেশে পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে এবং নিজ দেশে বিশাল ৫জি অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি আলিবাবা ও টেনসেন্টের নেতৃত্বে চীনের ডিজিটাল অর্থনীতি বিশ্বে এক অনন্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে, যা এখন দেশটির মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকের সমান।

সাংহাইয়ের আলোক ঝলমল শহরে এক গোধূলি সন্ধ্যায় লেখক

চীনের প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের ডিজিটাল বিপ্লব

বাংলাদেশও এই প্রযুক্তি বিপ্লব থেকে পিছিয়ে নেই। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণার পর থেকে চীনা প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ আমাদের টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও ফিনটেক খাতকে শক্ত ভিত দিয়েছে। হুয়াওয়ে ও জেডটিই বাংলাদেশের টেলিকম নেটওয়ার্ক নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। তারা শুধু তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের নেটওয়ার্ক নয়, পঞ্চম প্রজন্মের পরীক্ষামূলক প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে। ফিনটেক খাতে বিকাশের সফলতা বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত খুলেছে। এই সেবার প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ও নেটওয়ার্ক নিরাপত্তায় চীনা অবদান উল্লেখযোগ্য। ভবিষ্যতে আলিপে বা উইচ্যাট পের ধাঁচে আরও উন্নত ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তরসহ বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনে চীনা কোম্পানিগুলোর স্মার্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, ভিডিও নজরদারি ও স্মার্ট আলো ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নগর ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। চীনের ‘সুরক্ষিত নগরী’ ধারণার অনুসরণে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি সেবার দক্ষতাও বেড়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাংলাদেশের জন্যও সম্ভাবনার নতুন অধ্যায় খুলছে। কৃষিক্ষেত্রে ফসলের রোগ শনাক্তকরণ থেকে শুরু করে টেলিমেডিসিনে রোগ নির্ণয় সব ক্ষেত্রেই চীনা এআই মডেল কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে। একইভাবে শিক্ষা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষণব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এমনকি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাতেও এআই এখন গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের আগাম পূর্বাভাসে এটি ভূমিকা রাখছে।

ডিজিটাল সিল্ক রোড ও বাংলাদেশ

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে তথ্য ও প্রযুক্তি এখন বৈশ্বিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। এই প্রেক্ষাপটে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘ডিজিটাল সিল্ক রোড’ যা অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে ডিজিটাল অবকাঠামো, তথ্য বিনিময় ও প্রযুক্তিগত সংযোগ স্থাপনের নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এই উদ্যোগ এক বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ডিজিটাল সিল্ক রোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল ইন্টারনেট সংযোগ বা টেলিকম নেটওয়ার্কেই নয়, বরং আঞ্চলিক ডেটা হাব হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রবাহের কেন্দ্র হয়ে ওঠার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান ও উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি হবে। চীনের সবুজ প্রযুক্তিও এই সহযোগিতাকে আরও গভীর করছে। সৌর শক্তি, ব্যাটারি সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং বৈদ্যুতিক যান ব্যবহারে চীনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের শক্তি খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের পথ আরও সুগম হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স ও তথ্যবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের তরুণরা নতুন প্রযুক্তি যুগের নেতৃত্ব দিতে পারবে। ডিজিটাল সিল্ক রোড তাই কেবল অবকাঠামো নয়, এটি জ্ঞান, দক্ষতা ও সহযোগিতার এক সেতুবন্ধন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতের স্মার্ট অর্থনীতির পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ২০১৭ সালে ইউনান ইউনিভারসিটির বাংলা ক্লাসরুম থেকে শুরু করে ২০১৮ সালে সেনজেনের হাই-টেক ফ্যাক্টরি পর্যন্ত আমার যাত্রা আমাকে একটি বাস্তব সত্যের মুখোমুখি করেছে, চীন কেবল নিজের অর্থনীতিকেই নয়, বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চীনের প্রযুক্তি উত্থান বাংলাদেশের জন্য কোনো প্রতিযোগিতা নয়; বরং এটি সহযোগিতা ও সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত। এই সম্ভাবনাকে সফলভাবে কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে হতে হবে আরও বুদ্ধিমান, দূরদর্শী ও প্রযুক্তিবান্ধব অংশীদার। কারণ, চীন-বাংলাদেশের এই প্রযুক্তি বন্ধুত্বই হতে পারে প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ বাস্তবায়নের সবচেয়ে কার্যকর চালিকাশক্তি।

ইউরোপের আদলে তৈরি চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে ইউরোপিয়ান টাউনে লেখক

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

গত বছরের নভেম্বরে ইউনান ইউনিভারসিটিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান সাত দিনের সফরে চীনে যান। তিনি চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখে বিস্মিত হন। বাংলাদেশ চীনের সহযোগিতায় নানান ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম বলে তিনি মনে করেন। নিয়াজ আহমদ খান বলেন, চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা বাংলাদেশের ডিজিটাল সাংবাদিকতা এবং ডিজিটাল অর্থনীতিতে একটি সত্যিকারের বিপ্লব ঘটাবে। টেলিকম অবকাঠামো, ফিনটেক এবং স্মার্ট সিটি সলিউশনে চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সমর্থন বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করছে। চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধান দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও ব্যবসা খাতকে আধুনিকীকরণে সহায়তা করছে। এই অংশীদারিত্ব বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ডিজিটাল হাব হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি এআই ও ডেটা চালিত উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে, যা একটি উন্নত ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গঠনে মূল চালিকাশক্তি হবে।

দেশের সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক প্রেসিডেন্ট রাসেল টি আহমেদ বলেন, চীনের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাংলাদেশের ডিজিটাল সাংবাদিকতা ও অর্থনীতিকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে প্রস্তুত। বিশেষত এআই-চালিত টুলস এবং ৫জি অবকাঠামো, যা চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় গড়ে উঠছে, তা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে রিয়েল টাইম ডেটাভিত্তিক রিপোর্টিং এবং মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরিতে বিপ্লব ঘটাবে। মোবাইল জার্নালিজম থেকে শুরু করে উন্নত ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত, চীনের সাশ্রয়ী ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবন ও কর্মপদ্ধতিকে রূপান্তরিত করছে। এই সহযোগিতা শুধু প্রযুক্তি হস্তান্তর নয়, বরং জ্ঞান ও মানবসম্পদ উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে, যা বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করবে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সভাপতি মুরসালিন নোমানী বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন দ্রুত পরিবর্তনের পথে এবং এই রূপান্তরে চীনা প্রযুক্তির ভূমিকা স্পষ্ট। চীনের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের নিউজরুমগুলোতে ভিডিও অটোমেশন, ক্লাউড ব্রডকাস্টিং ও মোজো সাংবাদিকতার প্রসার ঘটছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। মুরসালিন নোমানী বলেন, ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা হবে ডেটা-নির্ভর, এআই সক্ষম এবং অডিয়েন্স ড্রিভেন আর চীন এই রূপান্তরের বাস্তব প্রয়োগ দেখিয়ে দিচ্ছে। একইসঙ্গে চীনের প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ বাংলাদেশের ডিজিটালভিত্তিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে ই-গভর্ন্যান্স, স্মার্ট সিটি, ফিনটেক, সাইবার নিরাপত্তা এবং টেক স্কিল ডেভেলপমেন্টে যৌথ উদ্যোগ ভবিষ্যৎ উন্নয়নের গতি বহুগুণে বাড়াবে। বাংলাদেশকে ডিজিটালি ২.০ নির্মাণে চীন এখন সবচেয়ে কার্যকর কৌশলগত অংশীদার বলে মনে করেন তিনি।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও ফ্লোরা টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম ডিউক বলেন, চীনের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাংলাদেশকে শুধু ডিজিটাল অবকাঠামো দিচ্ছে না, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক মডেল গড়ার সুযোগ তৈরি করছে। সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, এআই গবেষণা, ডেটা সায়েন্স ট্রেনিং এবং ক্লাউড কম্পিউটিং অ্যাক্সেস বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও ডিজিটাল অর্থনীতিকে সমান্তরালভাবে শক্তিশালী করছে। মিডিয়া সেক্টরে কনটেন্ট অটোমেশন, স্মার্ট ডিস্ট্রিবিউশন এবং ফ্যাক্ট চেকিং এআই যেমন নতুন মান নির্ধারণ করবে, তেমনি ডিজিটাল ট্রেড, ফিনটেক এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতি অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। ভবিষ্যৎ স্পষ্ট বাংলাদেশ যদি নীতিগত স্থিতিশীলতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারে, তবে চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আগামী দশকে এক অর্থনৈতিক বিপ্লব আনতে সক্ষম হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

মোবাইল ফোন সমাজের ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে : টুকু

ক্র্যাব স্পোর্টস ফেস্টিভ্যাল ২০২৫ উদ্বোধন মোবাইল ফোন সমাজের ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে : টুকু

ব্যাংকে বিত্তশালীদের হিসাব ১ লাখ ২৮ হাজার

ব্যাংকে বিত্তশালীদের হিসাব ১ লাখ ২৮ হাজার

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এনইআইআর নীতিমালা রিভিউ করা হবে

আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এনইআইআর নীতিমালা রিভিউ করা হবে

অর্থ, পেশীশক্তি ও ধর্মের অপব্যবহারে অঙ্গীকার দাবি, ৫২ ‍সুপারিশ টিআইবির

অর্থ, পেশীশক্তি ও ধর্মের অপব্যবহারে অঙ্গীকার দাবি, ৫২ ‍সুপারিশ টিআইবির

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App