সেবায় সংকট, প্রশাসন ভারী: স্বাস্থ্যে ৭৮ হাজার পদ খালি

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:০৭ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
স্বাস্থ্য খাতের জনবল সংকট নতুন কিছু নয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এই সংকট মোচন না হওয়ায় জনগণ সেবাবঞ্চিত হন, তাদের ভোগান্তি বাড়ে। এই জনবল সংকটের কারণে সব ধরনের সুবিধা থাকার পরও সেবা পান না রোগীরা। আবার দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হয় সরকারের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যথারীতি এক ধরনের বক্তব্যই আসে। বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। আশা করি, এ সমস্যার দ্রæত সমাধান হবে। কিংবা রাতারাতি জনবল সংকটের সমাধান করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
প্রতিনিধির পাঠানোর তথ্য অনুযায়ী, নওগাঁর জেলার বদলগাছী উপজেলার জেলা সদর হাসপাতালে ২৯টি চিকিৎসক পদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত আছেন মাত্র ৫ জন। ২৪টি পদই শূন্য। এক বছরের বেশি সময় ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালক নেই। হাসপতাল সূত্রে জানা যায়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে শিশু চিকিৎসক, মেডিসিন, সার্জারি, অর্থপেডিকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দীর্ঘদিন থেকে শূন্য। ফলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে ৫০ শয্যা হাসপাতালের ১৩৬টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন ৮৬ জন। বিশেষ করে জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন, গাইনি, সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়া), মেডিকেল অফিসার, সিনিয়র স্টাফ নার্স, টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্টসহ অন্যান্য পদে রয়েছে বিপুল শূন্যতা। এছাড়া কোটি টাকা ব্যয়ে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন, ইসিজি মেশিন এবং ডিজিটাল আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন সরবরাহ করা হলেও এসব মেশিন সরবরাহ করার পরও কোনো টেকনিশিয়ান-গ্রাফার পদে লোক না থাকায় মেশিনগুলোর সুবিধা রোগীদের দিতে পারছে না।
চলতি বছরের মে মাসে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ থেকে ১০০ বেডের আধুনিকমানের নতুন ভবনটি বুঝে নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে ১০০ বেডের ভবন হস্তান্তর হলেও জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে এখনো কার্যক্রম চালু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। সেই ৫০ বেডের জনবলেই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম চলছে। হাসপাতালটিতে ৭০ জন চিকিৎসক ও ৪৫ জন নার্সের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে যে ৫০ শয্যা হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে, সেখানে ১৯ জন চিকিৎসক ও ৩৬ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও চিকিৎসক রয়েছেন ১১ জন, আর নার্স রয়েছেন ২৮ জন।
প্যাথলজি বিভাগে ৩ জনের জায়গায় কেউ নেই, মাদারীপুর জেলা সদর থেকে একজনকে এনে অস্থায়ীভাবে কাজ চালানো হচ্ছে। কনসালট্যান্ট (সার্জারি), কনসালট্যান্ট (অর্থোপেডিকস), কনসালট্যান্ট (গাইনি), আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) এবং অ্যানেসথেটিস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য থাকায় জটিল রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক্স-রে মেশিন থাকলেও টেকনিশিয়ান না থাকায় সেটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ক্লিনার বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ৪টি পদের সবই শূন্য। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার শ্রীকাইল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রে সৃষ্ট ৬টি পদ থাকলেও সবকয়টি পদই শূন্য। জনবলের অভাবে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত ইউনিয়নের জনগণ।
এমন চিত্র দেশের অধিকাংশ হাসপাতালেরই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একজন চিকিৎসকের সঙ্গে ৩ জন নার্স ও ৫ জন টেকনিশিয়ান থাকা উচিত। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ২৩ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। সেই হিসাবে প্রতি হাজারে অন্তত ২ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত চিকিৎসকের (২০২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত) সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৯৯। বাংলাদেশের জনসংখ্যা (১৭ কোটি ১০ লাখ) বিবেচনায় প্রতি হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন শূন্য দশমিক ৮৩ জন। বাংলাদেশে জনসংখ্যা ও চিকিৎসকের এ অনুপাত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহায়তায় করা ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য জনবল কৌশলপত্র-২০২৪’ পত্রে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ে মোট ৩৩ শ্রেণির পদ রয়েছে। এর মধ্যে খালি রয়েছে ৩২ শতাংশ পদ। এসব শ্রেণিতে মোট পদের সংখ্যা ২ লাখ ৪৪ হাজার ৭১১টি। এর মধ্যে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৩৪ পদে জনবল আছে। আর পদ খালি আছে ৭৭ হাজার ৮৭৭টি।
তাতে আরো বলা হয়, শূন্য পদের হার সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বিভাগে। এই বিভাগে ১৫ হাজার ৯৭৬টি পদের বিপরীতে শূন্য পদ ৪ হাজার ২২৬টি, যা মোট পদের ২৬ শতাংশ। আর শূন্য পদের হার সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে। এই বিভাগে পদ আছে ১৪ হাজার ৫৩৬টি; এর মধ্যে ৫ হাজার ৮২৭ পদেই কোনো জনবল নেই, যা মোট পদের ৪০ শতাংশ। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শ্রেণিতে শূন্য পদের হার বেশি। এটি ৬২ শতাংশ। চিকিৎসকদের পদ খালি ৪০ শতাংশ। এছাড়া ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ৪০ শতাংশ পদে লোক নেই।
কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, জনবল সংকটের কারণে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হয় সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ বা রোগীদের। বাড়তি কাজের চাপ পড়ে নার্স, চিকিৎসকদের ওপরও। চিকিৎসকদের মধ্যে বাড়তি চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ে মেডিসিন, শিশুস্বাস্থ্য, অ্যানেসথেটিস্ট, স্ত্রীরোগ ও শল্যচিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের ওপর। এছাড়া নার্সিংসেবা সংশ্লিষ্টদের এ কাজের বাইরেও অন্য কাজও করতে হয়।
দেশের স্বাস্থ্য খাতে জনবল সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মঈনুল আহসান জানান, সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বরাবরই মূল সমস্যা জনবল সংকট। এ সংকট নিরসনে অধিদপ্তর সমন্বয় করে কাজ করছে। তবে এখানে আরেকটি সংকট হলো নিযুক্ত জনবলের সুষম বণ্টন। সর্বস্তরের জনগণ সেবা নিশ্চিত করতে ঢাকাভিত্তিক নিয়োগ না করে, তৃণমূল পর্যায়ে লোকবল নিয়োগ দেয়া জরুরি বলে মত দেন তিনি।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দেশে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে বলে জানার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি আরো জানান, সেপ্টেম্বর মাসে ৩ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আগে যেখানে এ ধরনের নিয়োগ সম্পন্ন করতে ৩ বছর লেগে যেত, এবার ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে সরকার।
স্বাস্থ্য খাতে কর্মী সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে আগস্ট মাসে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান জানান, বর্তমানে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ সম্পন্ন করতে প্রায় ৩ বছর সময় লেগে যায়। এই দীর্ঘসূত্রিতা কাটিয়ে সময়মতো জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদা একটি পিএসসি গঠনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে দেশের সব হাসপাতালের যন্ত্রপাতি একটি আইওটি ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। এর ফলে কম ব্যবহৃত মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলো চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত বুলেটিনের (নভেম্বর-২০২৪) তথ্য অনুযায়ী, দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি মাঠে সেবাদানকারীর ঘাটতি থাকলেও এই খাতের প্রশাসনিক শীর্ষ পদে অতিরিক্ত পদায়ন করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি পরিচালক, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও সমপর্যায়ের অনুমোদিত পদ রয়েছে ১৩৪টি। অথচ এসব পদে ১৮৯ জনকে পদায়ন করা হয়েছে। পদের চেয়ে অতিরিক্ত ৫৫ জন দায়িত্বে আছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উপপরিচালক ও সমপর্যায়ের পদ রয়েছে ১৫৬টি।
কিন্তু এ পদে জনবল আছে ৩১৪ জন। এ পদে অতিরিক্ত ১৫৮ জনকে পদায়ন করা হয়েছে। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক, সিভিল সার্জন ও সমপর্যায়ের অনুমোদিত পদ রয়েছে ২৮০টি। এর বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ৪৮৭ জন। অর্থাৎ অতিরিক্ত কর্মরত রয়েছেন ২০৭ জন। ডেপুটি সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার জন্য অনুমোদিত পদ রয়েছে ১ হাজার ১৭০টি। অথচ এ পদে কর্মরত আছেন ৩ হাজার ১৯৯ জন। পদের চেয়ে অতিরিক্ত ২ হাজার ২৯ জনকে পদায়ন করা হয়েছে।