ডেঙ্গু পরিস্থিতি
রোগীকে হাসপাতালে নিতে বিলম্বে বাড়ছে মৃত্যু-শনাক্ত

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪১ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বাড়ছে। দীর্ঘ হচ্ছে দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনের দিনগুলো আরো বেশি ভোগাবে এডিস মশাবাহিত এই রোগ। কারণ আগামীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন হবে, তা নির্ভর করছে বৃষ্টির ওপর। আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা তৃণমূল পর্যায় পৌঁছায়নি। চিকিৎসারও বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এ কারণে রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে যাচ্ছে। তাই মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে।
এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে দেখা গেছে, দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। ঢাকার হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন মোট আক্রান্তের মাত্র ২৫ শতাংশ। এবার ঢাকার বাইরে সংক্রমণ যেমন বেশি, তেমনি মৃত্যুও গত বছরের চেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, একসময় ডেঙ্গু শহরের রোগ ছিল। কিন্তু চলতি বছর ঢাকার বাইরে, অর্থাৎ গ্রাম ও মফস্বলে যেভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে, তা আগে কখনো হয়নি। সেই তুলনায় ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো ততটুকু প্রস্তুত ছিল না। ডেঙ্গু শনাক্ত এবং হাসপাতালে যেতে দেরি করায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে।
তিনি বলেন, চিকিৎসাসেবা এখনো শহরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে ঢাকাকেন্দ্রিক। ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসা জটিল। দীর্ঘ কয়েক বছরে ঢাকার চিকিৎসকদের এ বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু গ্রামে তেমনটা হচ্ছে না। উপজেলা হাসপাতালে রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। এ কারণে গ্রামের রোগীরা ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছে না। রোগীর অবস্থা যখন জটিল হচ্ছে, শুধু তখনই তাকে জেলা বা সেখানে না হলে ঢাকার দিকে পাঠানো হচ্ছে। ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে রোগীর মাল্টি অর্গান ফেইলিউর হয়। হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েও তাকে বাঁচানো যাচ্ছে না।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা মুশতাক হোসেনও চিকিৎসাসেবা বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে বলে মনে করেন। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, মৃত্যু কমছে না কারণ, চিকিৎসাব্যবস্থা এখনো বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। মানুষের দোরগোড়ায় ডেঙ্গুর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পারছি না। ফলে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা, অর্থাৎ বড় বড় সব মেডিকেল কলেজে রোগীরা ভিড় করছে। যেসব রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার, তাদের তা করতে পারছি না। মাঝারি মানের হাসপাতাল সৃষ্টি করতে পারছি না। প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা করতে না পেরে দরিদ্র মানুষ ডেঙ্গু পরীক্ষায় অনাগ্রহী হচ্ছেন। কারণ তারা মনে করেন, এতে পয়সা ও সময় নষ্ট।
আইইডিসিআর উপদেষ্টা ও সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, জ্বর ভালো হয়ে গেলে দরিদ্র মানুষ কাজে চলে যায়। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জ্বর ভালো হওয়ার পরই রোগী অসুস্থ হয়ে পড়ে। ব্লাড প্রেসার কমে যায়। তাই রোগীকে বিশ্রাম নিতে হয়। কিন্তু তারা তা করছে না। শেষ মুহূর্তে যখন হাসপাতালে যাচ্ছেন, তখন আর কিছু করারও থাকে না।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফরও স্বীকার করেন রোগীরা অনেক সময় দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। খারাপ অবস্থায় ভর্তি হচ্ছেন। ফলে চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সবার সচেতন হওয়া জরুরি। সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে বাড়িয়ে দিচ্ছে মৃত্যুর ঝুঁকি।
মহাপরিচালক বলেন, এই রোগ যদি শুরুতেই চিহ্নিত করা না যায়, সময়মতো চিকিৎসা শুরু না হয়, তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট প্রসঙ্গে তিনি জানান, ডেঙ্গু শনাক্তে ব্যবহৃত এনএস-১ কিট সব জায়গায় রয়েছে এবং পর্যাপ্ত মজুত আছে।
এদিকে ডেঙ্গুরোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ১২ দফা জরুরি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান স্বাক্ষরিত এই নির্দেশনার চিঠি দেশের সব মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক, জেলার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, সিভিল সার্জন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ডেঙ্গুরোগীদের জরুরি ভিত্তিতে এনএস ওয়ান পরীক্ষা করতে হবে। এনএসওয়ান/অ্যান্টিজেন কিটের জন্য সিএমএসডি অথবা সিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ভর্তি রোগীদের জন্য হাসপাতালে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
ভর্তি হওয়া রোগীদের হাসপাতালের নির্দিষ্ট ওয়ার্ড বা কক্ষে রাখতে হবে। ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য মেডিসিন, শিশু ও প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করতে হবে। বোর্ডের তত্ত্বাবধানে মেডিকেল অফিসার, রেসিডেন্ট ও প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের একটি দল গঠন করতে হবে, যারা কেবল এই রোগীদের চিকিৎসা করবেন।
নির্দেশনায় রয়েছে, বহির্বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে যারা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হবে, তাদের একটি নিদিষ্ট কক্ষে বিশেষজ্ঞ বোর্ড ও চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেবেন। আইসিইউর প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে সুবিধা থাকলে ডেঙ্গুরোগীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। রোগীর তথ্য সংরক্ষণ ও প্রেরণের জন্য একজন নার্সকে দায়িত্ব দিতে হবে। কোনো ডেঙ্গুরোগী মারা গেলে সংক্ষিপ্ত তথ্য ৬ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতাল পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককে (হাসপাতাল ও সিডিসি) জানাতে হবে।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। হাসপাতাল এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং মশকনিধন কার্যক্রম চালানোর জন্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়রকে চিঠি দেবেন হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক। প্রতি শনিবার সকালে হাসপাতালের পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক বা সিভিল সার্জনের সভাপতিত্বে ডেঙ্গু সমন্বয় সভা করতে হবে। অন্যান্য জেলা হাসপাতাল প্রয়োজনে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারবে।