ক্ষতির মুখে ট্রাভেল ব্যবসায়ী
বাংলাদেশি কেন ভিসা পাচ্ছেন না?
ঘর গোছাতে বললেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৪৭ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
এক বছর আগেও দেদারসে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েছি। কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে ততই এর সংখ্যা কমে আসছে। বর্তমানে সৌদি এবং কাতার কিছু ভিসা দিলেও বাকি দেশগুলো প্রায় না দেয়ার মত আচরণ করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এই ব্যবসা করে টিকে থাকা যাবে না। এভাবেই হতাশার কথা জানালেন রাজধানী ঢাকার অন্যতম ট্রাভেল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রীতম ট্রাভেলসের মালিক প্রমোদ পাল। শুধু তিনিই নন, ওই এলাকার অন্তত ১০টি ট্রাভেল এজেন্সি ঘুরে প্রায় একইরকম তথ্য পাওয়া গেছে।
একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভ্রমণ গ্রুপগুলোতেও এখন এমন হতাশা নিয়মিত চোখে পড়ে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, ভিসা ফি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়ার পরও কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই আবেদন বাতিল করা হচ্ছে। তবে সরকার বলছে, ঠিকঠাক তথ্য না দেয়ায় আবেদনকারীর ভিসা আবেদন বাতিল হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্রাভেল ব্যবসায়ী বলেছেন, কেন বাংলাদেশিদের ভিসা পাচ্ছেন না তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এ বিষয়ে কি সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আপনার আলোচনা হয়নি-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একবার নয়, বহুবার আলোচনা হয়েছে। মূলত সরকারই এ বিষয়ে গভীরভাবে নজর দিতে রাজি নয়। শুধু বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে দায় খালাস করার একটি প্রবণতা দেখেছি। তারমতে, যেভাবে ভিসা প্রত্যাখান বাড়ছে এবং তা চলমান থাকলে দেশের অনেক ক্ষতি হবে। বর্হিবিশ্বে মর্যাদা সংকটে পড়বে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ ও ভিসা সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছু কারণে একদিকে ভিসা প্রত্যাখ্যানের পরিসংখ্যান যেমন বেশি অন্যদিকে ভিসা প্রাপ্তির শর্ত আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ট্যুর অপারেটর এবং ভ্রমণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র অনুসারে, অন্তত এক ডজন দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে অথবা নানা শর্তের অভাব দেখিয়ে আবেদন প্রত্যাখ্যান করছে। পাকিস্তান বাদে অন্যান্য দেশ তাদের ভিসা প্রক্রিয়া শর্তসাপেক্ষে অত্যন্ত কঠিন করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম, লাওস, মিশর, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান সম্পূর্ণ ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। চিকিৎসা ও শিক্ষা গন্তব্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় প্রতিবেশি ভারতও এখন সীমিতসংখ্যক ভিসা দিচ্ছে।
তারা বলেন, উপসাগরীয় অঞ্চল ও মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান এবং মালয়েশিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তিনটি শ্রমবাজার হলেও দেশগুলোতে শ্রমিকদের ভিসা প্রদান সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। মালয়েশিয়াতো এখন নিয়মিতই তাদের বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাচ্ছে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত তিন মাসে ৩৬ জন বাংলাদেশিকে আটক করে মালয়েশিয়ার পুলিশ। আটককৃতরা বাংলাদেশ ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট বা আইএস সদস্যদের অর্থায়ন করতো বলে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশকে জানিয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি বা জঙ্গিবাদ কার্যক্রমে বাংলাদেশি নেই বলে জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য (আবেদনকারীদের) অন্তরায়। ভারতের ভিসা বন্ধ এবং অন্য অনেক দেশেও বন্ধ, এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নিতে পারে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ঘর গোছাতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেলস এজেন্সি। আপনি যা তৈরি করতে পারবেন সেটাই আমি বিক্রি করতে পারব। আপনি যদি মিথ্যা তথ্য দেন, ভুল পাসপোর্ট দেন, তাহলে তো সমস্যা হবে। উপদেষ্টা বলেন, মিথ্যা তথ্য একটা প্রধান সমস্যা আমাদের। এটা এখনো আগের মতো চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু এটা সহজে ধরা পড়ে যায়। এ কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ঘর ঘোচাতে হবে। এ ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম যেন না হয় সেটা দেখতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে আমরা এটা ঠিক করে নিয়ে আসতে পারব।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোও বাংলাদেশিদের এখন ভিসা দেয়া কমিয়ে দিয়েছে। ভিসা প্রক্রিয়াকরণে কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস পর্যন্ত সময় লাগছে, আর প্রত্যাখ্যানের হারও বেড়ে চলেছে। একটি বেসরকারি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালেই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশিদের তিন শতাধিক ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে সংখ্যাটি চলতি বছর আরো বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (বোটঅফ) জানিয়েছে, গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে বহির্গামী পর্যটন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ এবং কর্পোরেট ভ্রমণ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এই পরিস্থিতির জন্য তারা ব্যাপক ভিসা বিধিনিষেধ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করছেন। বোটঅফ সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান বলেন, যদি নির্বাচন পর্যন্ত এ অবস্থা চলে, তাহলে অনেক ছোট ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে অনেকে কোভিডের সময়ের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে আছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশিদের এখন বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। তারা বলছেন, আগে ইউরোপ-আমেরিকার ভিসার ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যানের হার বেশি থাকলেও এখন যেন সেটা অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাদ যাচ্ছেন না সেলিব্রেটিরাও। সম্প্রতি নামি বাংলাদেশি ভ্রমণ বিষয়ক ইউটিউবার ও ব্লগার নাদির নিবরাস এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। নাদির নিবরাস সম্প্রতি তিনটি দেশের ই-ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। গত ৪ জুলাই এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, তাজিকিস্তানের মতো সাধারণ ভিসাও তিন সপ্তাহ অপেক্ষার পর রিজেক্ট। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার ভিসা দেখিয়েও কোনো লাভ হলো না।
নাদির জানান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার বৈধ ভিসা এবং পর্যাপ্ত অর্থ থাকলেও তাজিকিস্তানের মতো সাধারণ ই-ভিসাও পাননি তিনি। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়, ফি-ও ফেরত দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকলে অনেক দেশের ভিসা যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে ততটা না। মলদোভা ও বাহরাইনের ই-ভিসার ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। নাদির বলেন, অনেকে জানতে চান আমি যুদ্ধবিধ্বস্ত বা বিতর্কিত দেশগুলোতে যাই না কেন। আসলে এমন দেশের ভিসা পাসপোর্টে থাকলে উন্নত দেশের ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সে ঝুঁকি এখন নেয়া সম্ভব না।
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশিদের জন্য কার্যত ভারতের ভিসা বন্ধ। মেডিকেল ইস্যুসহ অতি জরুরি বিষয়ে ভিসা চালু রয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন। তবে এখনো চিকিৎসার প্রয়োজনে অনেকেই ভিসা পাচ্ছেন না বলে জানায় তারা। আর শিক্ষার্থীদের ভিসার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, আমরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে জরুরি মেডিকেল ভিসাগুলো দেয়ার চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে বাকি ভিসা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। ভারতীয় হাইকমিশন সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে নিরাপত্তা ইস্যুতে ভারতীয় হাইকমিশন ও ভিসা সেন্টারে অনেক কর্মকর্তাই এখনো বাংলাদেশে ফেরেননি। ফলে জনবল সংকট রয়েছে। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যকার শীতল সম্পর্কও ভিসা জটিলতার জন্য দায়ী।
পশ্চিমা দেশগুলোর ভিসা পাওয়া যেন আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহামা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের খরচে ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থী জানান, দীর্ঘ প্রস্তুতির পরেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে তার ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ভিসা আবেদনকারী বলেন, আমার দুই বছরের প্রস্তুতি দুই মিনিটেই শেষ। আমার চোখের সামনে ১০-১২ জন ভিসার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু তাদের সবাইকে ভিসা প্রত্যাখ্যাত হতে দেখেছি। এদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রয়োজনীয় নথি যাচাই-বাছাইয়ের পর ভিসা দেয়া না দেয়া সম্পূর্ণভাবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ওপর নির্ভর করে। এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূতও সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
ভ্রমণ ও ভিসা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিজ্ঞতার কথাও একই রকম। মুবিন এয়ার সার্ভিসের বিপণন কর্মকর্তা রাসেল খান বলেন, আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সহজেই ভিসা দিতো। এখন সেই দেশগুলোও বাংলাদেশিদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করছে। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর-সবখানেই প্রত্যাখানের হার বেড়েছে। এর পেছনে বাংলাদেশ থেকে বেড়ে চলা অবৈধ অভিবাসনের হার এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বড় ভূমিকা রাখছে। এসব সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
ভিএফএস গ্লোবালের একজন কর্মী বলেন, আমরা ভিসা প্রসেসিংয়ের সহায়তা করি, অনুমোদন দিই না। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, বর্তমানে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচন কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের সময়ও একই রকম পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল, বলেন ওই ভিএফএস কর্মকর্তা।