শেখ হাসিনার পতনের পরে যেভাবে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার

বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ০৬:৩৭ পিএম

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ পাঠ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি
শেখ হাসিনা সরকারের এত তাড়াতাড়ি পতন হবে, সেটা ভাবেননি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা। তবে আন্দোলনের এক পর্যায়ে সেই সরকারের পতন হলে কীভাবে নতুন সরকার গঠন হবে, সেটা নিয়ে তারা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন। সেই সরকারের প্রধান হিসেবে চিন্তা করে আগস্টের শুরু থেকেই নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন। পাঁচই আগস্ট দুপুরে বাংলাদেশের বেতার- টেলিভিশনে যখন সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন বলে খবর আসতে শুরু করে, তখনই সবাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, দেশের ক্ষমতায় বড় পরিবর্তন আসছে।
এর কিছু পরেই জানা যায়, গণ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সামরিক বিমানে করে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। দুপুরের পর এই তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়, অন্যদিকে সেই সময়টাতে আওয়ামী লীগ বাদে প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সেনাসদরে বৈঠক করছিলেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেই বৈঠক শেষে বিকাল চারটার দিকে তিনি ঘোষণা করেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। বিকেল চারটার দিকে এক ব্রিফিংয়ে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এখন একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবো। সোমবার রাতের মধ্যেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে তিনি জানান।
তবে সেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হতে আরো তিনদিন সময় লেগেছে, এর মধ্যে ঘটেছে নানা নাটকীয়তা। কার্যত এই তিনদিন বাংলাদেশ অনেকটা সরকার বিহীন অবস্থার মধ্যে ছিল। সেই সময়ে দেশের অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কীভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে? কে বা কারা সেই সরকারের দায়িত্ব নেবেন? সংবিধানে এরকম সরকারের বিধান না থাকায় তার আইনি ভিত্তি কী হবে?
নতুন সরকার নিয়ে সেনাসদর ও বঙ্গভবনে আলোচনা
সোমবার বিকালে ওই ভাষণে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, সব দলের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি এবং তাদের সঙ্গে তার সুন্দর আলোচনা হয়েছে, যেখানে তারা একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেনাপ্রধান বলেন, 'আমরা সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে কথা বলেছি। আমরা সবাইকে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আমরা সুতরাং একটা আলোচনা করেছি। একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবো এবং এই সরকারের মাধ্যমে এ দেশের সব কার্যকলাপ চলবে। আমরা এখন রাষ্ট্রপতির কাছে যাবো। ওনার সাথে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করবো।
সেনাসদরের সেই বৈঠকে জামায়াতের আমির, বিএনপি মহাসচিব ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতা জুনায়েদ সাকী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ডঃ আসিফ নজরুল উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠকে আওয়ামী লীগের কেউ ছিলো না। গণ অভ্যুত্থান ও আন্দোলন নিয়ে 'জুলাই: মাতৃভুমি অথবা মৃত্যু' নামে একটি বই লিখেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
সেনা সদরের বৈঠকের বিষয়ে আসিফ মাহমুদ তার বইতে লিখেছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর নানা জায়গা থেকে তাদের কাছে বন্যার তো ফোন আসছিল। আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও যোগাযোগ করা হচ্ছিল। তারা বলল, সেনাবাহিনী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বসতে চায়। আমাদেরও খোঁজা হচ্ছে। আমি বললাম, আমরা ক্যান্টনমেন্টে যাব না। দেশের ভাগ্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে নয়, নির্ধারিত হবে জনতার মঞ্চ থেকে। সেনাসদরের বৈঠকের কিছুক্ষণ পরেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করার জন্য বঙ্গভবনে প্রবেশ করতে দেখা যায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী সহ বিভিন্ন দলের নেতাদের।
সেদিন জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য ছোট বা ইসলামপন্থি দলগুলোর নেতাদেরও সেখানে দেখা গিয়েছিল। আরো ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক ও সমন্বয়ক পরিচয়ে কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধি। ওই আলোচনা প্রসঙ্গে আসিফ মাহমুদ তার বইতে লিখেছেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর রাজনৈতিক নেতারা ক্যান্টনমেন্টে যান। সেখানে আমাদের কেউ ছিল না। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে আবদুল্লাহ আল হোসাইন ও আরিফ তালুকদার নামে দুজন এবং একজন নারী সেখানে যান। তারা কেউ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক না হলেও বঙ্গভবনে গিয়ে নিজেদের সমন্বয়ক পরিচয় দেন।
বঙ্গভবনের সেই বৈঠকের বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সেখানে আনুষ্ঠানিক কিছু কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু সরকার গঠনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কীভাবে সরকার গঠন হবে, সরকারের প্রধান কে হবেন, সেই বিষয়েও রাষ্ট্রপতির সাথে সরাসরি কোনো আলোচনা হয়নি। তখনো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে কোনো আলোচনা আসেনি বলে তিনি জানান। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে তার কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি তখন তার মতামত দিয়েছিলেন।
ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, তাদের আলোচনায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আজ রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনা করে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, পার্লমেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে অতিদ্রুত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হবে। সেই সাথে মুক্তি দেয়া হবে সেই সমস্ত ছাত্র নেতা-কর্মী, ছাত্রনেতাদের, যাতে অন্যায়ভাবে পহেলা জুলাই থেকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক কারণে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক নেতাদের ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া তাদের পছন্দ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতাদের
বঙ্গভবনে যখন রাষ্ট্রপতি, তিন বাহিনী প্রধান, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ওই বৈঠক চলছিল, সেই সময় ওই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতারা সংসদ ভবন থেকে গিয়েছিলেন ঢাকার তেজগাঁয়ে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে। রাজনৈতিক নেতাদের ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া তাদের পছন্দ হয়নি।
আসিফ মাহমুদ তার 'জুলাই: মাতৃভূতি অথবা মৃত্যু' বইতে লিখেছেন, 'চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরে গিয়ে শুনলাম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছেন। শুনে আমার মনটা খুবই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হাসনাত আবদুল্লাহকে ফোন করে বললাম, ক্যান্টনমেন্টে গেলে আপনাদেরও জাতীয় বেঈমান ঘোষণা করা হবে। হাসনাত ও সারজিক তখন সেনাবাহিনীর গাড়ি থেকে নেমে চলে আসেন।
সেখানে বসেই তারা অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে সেখানেই ঘোষণা করেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে প্রস্তাব দেবেন। তাদের প্রস্তাবিত বা সমথর্ন ছাড়া সরকার গঠন করা হলে সেটি মানবেন না। আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, সেই চ্যানেল টোয়েন্টিফোর কার্যালয়ের একটি ছোট সভাকক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমানের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, মাহফুজ আলম ও নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী ছিলেন।
তিনি লেখেন, তারেক রহমানকে আমরা অন্তর্বতীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিই এবং বিএনপিকে সেই সরকারে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাই। আমাদের প্রস্তাব ছিল জাতীয় সরকারে ৫০ শতাংশ রাজনৈতিক দলের এবং ৫০ শতাংশ সুশীল সমাজ ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি থাকবেন। তারেক রহমান বললেন, তারা এ ধরনের কিছুর অংশ হতে চান না। আমরা আমাদের সংস্কারের ভাবনাগুলো বললাম। তিনি সরাসরি বলছেন, এত বেশি দায়িত্ব নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে তো মনে হয় না। আপনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে একটা নির্বাচন দিয়ে দিতে পারেন। তারেক রহমান সেখানে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, একজন প্রধান উপদেষ্টা রেখে সাতজনের একটি সরকার গঠন করা, যারা তিনমাসের মধ্যে একটা জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে। তবে ছাত্ররা জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সেই বৈঠকটি শেষ হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক লিখেছেন, ওই বৈঠকের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়ে যান যে, জাতীয় সরকারের বিষয়ে বিএনপির আগ্রহ নেই। পরদিন জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে এই বিষয়ে বৈঠক করেন মাহফুজ আলম। কিন্তু বিএনপি আসছে না বলে আলাপটা সেখানে থেকে যায়। এরপর আর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় সরকারের বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
এই বছরের ৩১ জুলাই ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে নাহিদ ইসলামও তারেক রহমানের সঙ্গে ওই ভার্চুয়াল বৈঠকে জাতীয় সরকারের বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা লিখেছেন। তিনি লেখেন, তারেক রহমান এ প্রস্তাবে সম্মত হননি এবং নাগরিক সমাজের সদস্যদের দিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাজেশন দেন। আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা বলি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে।
ওই টেলিভিশন কার্যালয়ে বসেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ঘোষণা দেন, তারা বাংলাদেশে একটি জাতীয় সরকারের কথা ভাবছেন এবং এমন একটি সরকারের প্রস্তাবনা তারা জাতির কাছে তুলে ধরবেন। যারা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, অংশ নিয়েছে সেসব প্রতিনিধি, নাগরিক নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবার অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের কথা ভাবছি। রাতে নতুন সরকারের বিষয়ে তাদের প্রস্তাবনা তুলে ধরবেন বলে জানানো হয়।
অনেকটা একই সময় বঙ্গভবনের বৈঠকটিও শেষ হয়ে যায়। রাত আটটায় সার্ক ফোয়ারা এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান, তারা আগামী চব্বিশ ঘণ্টার একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করবেন এবং তাদের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত ছাড়া কোনও সরকার তারা সমর্থন করবেন না। সেনা সমর্থিত সরকার হতে পারে কিংবা জরুরি অবস্থা দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত হতে পারে – 'এ ধরনের কোনও সরকারকে বিপ্লবী ছাত্র জনতা গ্রহণ করবে না'।
সোমবার এর কিছুক্ষণ পরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সেই ভাষণে তিনি বলেন, অনতিবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে এবং পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করবে। যদিও সেই সময় রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে কীভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে।
আদালতের রায়ের পর বাংলাদেশের সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। আবার সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়েও কিছু বলা নেই। ফলে কোন প্রক্রিয়ায় বা কীভাবে এই সরকার গঠন করা হবে, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক সেই সময় বলেন, সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে কিছু বলা নেই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছিলেন, পোস্ট ভ্যালিডিটি দিয়ে 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার' গঠন করা যাবে। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা হন তিনি।
ড. ইউনূস যেভাবে আলোচনায় এলেন
আন্দোলন যখন জোরালোভাবে চলছে, তখন সরকার পতন হলে নতুন সরকারের প্রধান কে হবেন, সেটা নিয়ে আগস্ট মাসের শুরু থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন ছাত্রনেতারা। সেজন্য নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারা যোগাযোগও করতে শুরু করেছিলেন। 'জুলাই: মাতৃভূতি অথবা মৃত্যু' বইতে এমনটাই লিখেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও পরবর্তীতে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তিনি শীর্ষ নেতৃত্বের রোষানলেও ছিলেন। 'জুলাই:মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু' বইতে আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, আগস্টের মোটামুটি শুরু থেকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার টিমের মাধ্যমে যোগাযোগ ঘটে। টিমের একজন দেশের বাইরে তার বৈঠক বা যোগাযোগের বিষয়গুলো দেখতেন। সাবেক ছাত্রদল নেতা আশিক আহমেদের মাধ্যমে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল।
ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি তিনি নাহিদ ইসলামকেও জানিয়ে রেখেছিলেন। পাঁচই আগস্ট সন্ধ্যায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের কার্যালয়ে বসেই তারা ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা হয়। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের কার্যালয় থেকেই আমি তাকে ফোন করি। ফ্রান্সের যে হাসপাতালে তিনি ভর্তি ছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্ত্রোপচারের জন্য সেটির অপারেশনকক্ষে তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। লাউড স্পিকারে আমি আর নাহিদ ভাই তার সঙ্গে কথা বলি। সেদিনই নাহিদ ইসলামের সঙ্গে তার প্রথম কথা হলো। অধ্যাপক ইউনূসকে বললাম, স্যার, সরকারের তো পতন হয়ে গেছে। এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাকে আমরা জাতীয় সরকারের ধারণার কথাটাই বললাম। অধ্যাপক ইউনূস বললেন, তিনি ইতিবাচক। তবে অনেকগুলো ব্যাপার আলোচনা করতে হবে। সবাইকে জানালাম, অধ্যাপক ইউনূস ইতিবাচক।
আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, রাতেই আমরা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করলাম। তার সঙ্গে লাউড স্পিকারে নাহিদ ভাই আর আমার ঘণ্টাখানেক কথা হলো। অধ্যাপক ইউনূসকে বললাম, 'স্যার, দেশের যে পরিস্থিতি, তাতে দ্রুত ঘোষণা করা দরকার দেশের পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা কে হচ্ছেন।' অধ্যাপক ইউনূস এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন যে এক-এগারোর মতো সেনাসমর্থিত সরকার হলে তিনি দায়িত্ব নেবেন না। সরকার তার মতো করেই চলতে হবে। অন্য কেউ সরকার চালালে তিনি থাকবেন না।
উপদেষ্টা লেখেন, অধ্যাপক ইউনূসকে জানালাম, এটা আমাদেরও মত। সেনাসমর্থিত সরকার হলে আমরাও মানব না। অধ্যাপক ইউনূস ব্যাপারটা নিয়ে আগেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলে নিতে বললেন। নাহিদ ভাই তাকে বললেন, হস্তক্ষেপ না করার কথা বললে আমাদেরই দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। এর চেয়ে অভ্যুত্থানের প্রতি মানুষের একাত্মতা আর মাঠের শক্তি দিয়েই আমরা তাদের ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার বিষয়টা বোঝাতে পারব। দীর্ঘ আলোচনার পর অধ্যাপক ইউনূস সম্মত হলেন। 'রাত তিনটায় আমি, নাহিদ ভাই ও বাকের ফেসবুকে একটা ভিডিওতে অধ্যাপক ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে সম্মত হওয়ার কথা ঘোষণা করি।
সেদিন দিবাগত রাত মঙ্গলবার ভোরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও বার্তা পোস্ট করে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। বিকালে ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোরশেদ জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেছেন, যে ছাত্ররা এতো ত্যাগ স্বীকার করেছে, এই কঠিন সময়ে তারা যখন আমাকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছে, আমি কিভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করতে পারি?
পরবর্তীতে দায়িত্ব নেওয়ার পরে ২৫ আগাস্ট জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ছাত্ররা তাদের (উপদেষ্টা পরিষদের) প্রাথমিক নিয়োগকর্তা, তারা যখন বলবে, তখন তারা চলে যাবেন। সেদিন মঙ্গলবার দুপুরের দিকে রাষ্ট্রপতির আদেশে দ্বাদশ সংসদ বিলুপ্তির প্রজ্ঞাপন জারি হয়। সেই সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগাযোগ ঘটছিল।
আসিফ মাহমুদ তার বইতে লিখেছেন, রাষ্ট্রপতি সংসদ ভাঙার ঠিক আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। তিনি বললেন, সেনাপ্রধান আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। কিছুক্ষণ পরে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি খুব আক্ষেপ করে বললেন, আমার ৭০ থেকে ৮০ হাজার ফোর্স ডেপ্লয়েড, কিন্তু দেশে কোনো আইনশৃঙ্খলা নেই। সরকার নেই। আপনারা আসুন। আপনাদের সঙ্গে বসি। শুনি, আপনারা কী বলতে চান?
তিনি লেখেন, সেনাপ্রধান আমাদের ক্যান্টনমেন্টে ডাকলেন। আমরা বললাম, ক্যান্টনমেন্টে যাব না। হতে পারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আপনাদের সঙ্গে কোনো খোলা জায়গায় বসতে পারি। সেনাপ্রধান বললেন, 'খোলা জায়গায় তো নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। কখন কী ঘটে, বলা যায় না।' তিনি বললেন, 'বঙ্গভবন একটা জায়গা হতে পারে। আপনারা আসুন, আমরা একটা গাড়ি পাঠাই। ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় আমরা ১৫ জনের মতো বঙ্গভবনে গেলাম। এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যম অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছে। তিনি বললেন, শিক্ষার্থীরা এত ত্যাগ করতে পারলে আমারও কিছু দায়িত্ব আছে। কথা ছিল, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি এবং তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আমরা বসব। দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থাকার কারণে আলোচনার জন্য আমাদের বঙ্গভবনে যেতে হয়েছিল। বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে আমরা ১১ জনের একটা উপদেষ্টা পরিষদের একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করি।
বঙ্গভবনে ওই বৈঠক প্রায় প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলে। বৈঠক শেষে রাত সোয়া ১২টার দিকে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছেন, রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সরকারের বাকি সদস্য হিসাবে তারা একটি তালিকা দিয়েছেন, যেখানে নাগরিক সমাজসহ ছাত্র প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। নাহিদ ইসলাম লেখেন, আমরা একটা তালিকা দিয়েছি। এই তালিকা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের সাথে আলোচনা করে এটা চূড়ান্ত করা হবে এবং খুব দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চূড়ান্ত করা হবে। ছাত্র ও নাগরিক অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ থেকে যে সরকারের প্রস্তাব করা হবে, সেই প্রস্তাবিত সরকারই চূড়ান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে সেই নিশ্চয়তা আমরা বঙ্গভবন থেকে পেয়েছি।
সেই সময় নাহিদ ইসলাম জানান, অন্তর্বতী সরকারের জন্য ১০ থেকে ১৫ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও পরবর্তীতে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে গঠন করতে যাওয়া এই সরকারকে বৈধতা দেওয়ার সাংবিধানিক নানা রীতি আছে, নিয়ম আছে, সেগুলো অনুসরণ করা হবে বলে তিনি জানান। সরকারের কোনো মেয়াদ ঠিক হয়নি বলেও তিনি জানান। সেদিন রাতে রাষ্ট্রপতি কার্যালয় থেকেও একটি বিবৃতিতে জানানো হয়, বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
অন্তর্বতী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করে বাকি উপদেষ্টাদের একটি সম্ভাব্য তালিকা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সেই সময়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে ১৫ জনের তালিকা দেওয়া হয়েছিল। ড. ইউনূসের পক্ষ থেকেও একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য সেই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সদস্য ও পরবর্তীতে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাতই আগস্ট রাতে বলেন, সমন্বিত রূপরেখা আজ ঘোষণা করা হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করা হচ্ছে। কারা কারা থাকতে পারেন, কতজন থাকতে পারেন—এসব নিয়ে আলোচনা চলছে৷ কোন রূপরেখা ও কাজের ভিত্তিতে দপ্তর ভাগ হবে, কী হবে না হবে, সেটি আজ ড. মুহাম্মদ ইউনূস আসার পর তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
কমিটির আরেকজন সদস্য নাসীর আবদুল্লাহ সেই সময় বলেন, লিয়াজোঁ কমিটির পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজেরপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকে বিভিন্ন নাম দিয়েছেন। সব পক্ষের সঙ্গে কথা চলছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও কিছু নাম প্রস্তাব করা হয়। ছাত্ররা তাদের পক্ষ থেকে দুইজনকে উপদেষ্টা পরিষদে রাখার প্রস্তাব করেন। রাষ্ট্রপতিও সুপারিশ করেন যেন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়। নাহিদ ইসলাম তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ৭ই আগস্ট ভোরবেলা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বাসায় আমরা উনার সাথে অন্তর্বর্তী সরকার ও উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে আলোচনা করি। উপদেষ্টা পরিষদ শপথ নেবার আগে জনাব তারেক রহমানের সাথে আরেকটি মিটিং এ প্রস্তাবিত উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ নিয়ে আলোচনা/পর্যালোচনা হয়।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৯ জুলাই এক সাক্ষাৎকারে বলেন, (বৈষম্যবিরোধী) ছাত্রদের নেতাদের সঙ্গে ওই ৫ আগস্টের পর, জাস্ট ওই দিনই বা তার পরের দিন আমাদের কোনো দেখাই হয়নি। আমাদের কাছে এই প্রস্তাব আসেইনি। এই প্রস্তাবটা ছাত্রদের কাছ থেকে আসেনি, অন্য মহল থেকে আসতে পারে। কিন্তু ছাত্রদের কাছ থেকে এই প্রস্তাব আসেনি জাতীয় সরকার তৈরি করার।
তখন ফ্রান্সে থাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সেই তালিকা ও রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের বিষয়ে অবহিত করা হয়। ঢাকায় ফেরার সময় ড. ইউনূস উপদেষ্টাদের একটি তালিকা চূড়ান্ত করে ফেরেন বলে সেই সময়ের পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকায় নামার পর বিমানবন্দরেই তালিকার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক, তিন বাহিনীর প্রধান, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে ড. ইউনূস আলোচনা করেন বৈঠক সূত্রের বরাত দিয়ে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তালিকার বেশ কিছু নাম যোগ-বিয়োগের পর বিমানবন্দরেই সেই তালিকার চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়।
সরকার প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় বুধবার পরের দিকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের রায় বাতিল করে দেয় শ্রম আপিলেট ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান জানান, বৃহস্পতিবার রাত আটটা নাগাদ নতুন সরকারের শপথগ্রহণ হতে পারে। ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশের পথে রওনা দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধান বলেন, কাল শপথ গ্রহণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। বিকালে করার প্রস্তাব ছিল, কিন্তু খুব টাইট হয়ে যাবে। রাত আটটা নাগাদ হতে পারে। উনি দুপুর দুইটা দশে আসবেন। ৪০০ জন লোকের উপস্থিতি এখানে থাকবে। যদিও এই সময় বাংলাদেশে কার্যত কোনো সক্রিয় সরকার ছিল না, কিন্তু সামরিক বাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন, সচিবালয়, অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর সহ বিভিন্ন দপ্তরের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় রদবদল হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রজ্ঞাপন জারি করে এসব পরিবর্তন করা হচ্ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণ
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটার পর ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। বিমানবন্দরে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে তার প্রথম কাজ। সেদিন ঢাকায় অন্য একটি অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিজেদের মনোনীত বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ড ইউনূস তো আমাদেরই... ছাত্রদের, আমাদের মনোনীত ব্যক্তি যাকে আমরা গোটা জাতির পক্ষ থেকে দায়িত্ব দিয়েছি যে এই ইন্টেরিম গভর্মেন্টের দায়িত্ব তিনি পালন করবেন।
বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপরে ১৬ জন উপদেষ্টার নাম ঘোষণা করা হয়, যদিও সেদিন শপথ গ্রহণ করেন ১৩ জন। বাকিদের পরবর্তীতে শপথ পাঠ করানো হয়। সেই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়কও শপথ নেন। পরবর্তীতে আরো একজন যোগ দিয়েছিলেন।
উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, জনগণ যদি মনে করে যে তরুণরাই রাষ্ট্রের হাল ধরবে জনগণের সে আহবানে সাড়া দেয়ার জন্য বাংলাদেশের তরুণরা প্রস্তুত আছে। প্রায় তিনদিন ধরে বাংলাদেশ সরকার বিহীন একটি অবস্থার মধ্যে থাকার পরে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরু করল।
সরকার গঠনের পরদিন শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সংবিধানে না থাকায় রাষ্ট্রপতি বৃহস্পতিবার এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চেয়েছিলেন। সেদিনই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পক্ষে মত দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ।