×

জাতীয়

ইলিশের স্বাদ ভুলছে মানুষ

Icon

হরলাল রায় সাগর

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৯ পিএম

ইলিশের স্বাদ ভুলছে মানুষ

ছবি: সংগৃহীত

ইলিশের প্রাচুর্যের বাংলাদেশে এবার এর স্বাদ নেয়া বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভরা মৌসুমেও বাজারে ইলিশ অনেক কম। দাম আকাশছোঁয়া। একটি এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ টাকার ওপরে। বাজারে ১২০০ টাকার নিচে কোনো ইলিশ নেই। যা সাধারণ মানুষের কেনার সাধ্যের বাইরে। তাই মাছের রাজা এই লোভনীয় ইলিশের স্বাদ নিতে ভুলে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এই চিত্র রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র। তবে মৌসুমেও কেন ইলিশ নেই বাজারে? 

ইলিশ ধরার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা বলছেন, এবার সাগরে ইলিশ মাছের উৎপাদন ভালো। কিন্তু জেলেদের জালে ধরা পড়ছে কম। এর মধ্যে বড় মাছ আরো কম। এ কারণে বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম; দাম বেশি। যা বিগত বছরগুলোকে ছাপিয়ে গেছে। বিক্রেতারা বলছেন, এবারের মতো আগে এতো বেশি দাম ছিল কিনা তারা স্মরণ করতে পারছেন না। স্মৃতি হাতড়েছেন ক্রেতারাও। 

তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে ইলিশের যৌক্তিক দাম নির্ধারণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি দেড় মাসেও। এ কারণে মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের কব্জায় থাকা ইলিশের বাজার বেসামাল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিশ প্রাপ্তি অমাবস্যা-পূর্ণিমা ও বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। ফলে অমাবস্যা ও বৃষ্টি হলে শিগগিরই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। আগামী ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়ার আশা করছেন জেলে, আড়তদার ও মৎস্য কর্মকর্তারা। এই সময়ে মাছের দামও কমে যাবে।

চরম আয় বৈষম্যের সমাজ ব্যবস্থায় মাছের রাজাকে সব মানুষ ঘরে তুলতে পারবেন না এটা স্বাভাবিক। ইলিশ পাতে নিতে হলে প্রচুর অর্থ থাকতে হবে। কিন্তু অস্বাভাবিক দামে এ বছর সব ছাপিয়ে গেছে। যাদের হাতে টাকা আছে তাদেরও ইলিশ কিনতে ভাবতে হচ্ছে। রাজধানীর মালিবাগ বাজারে ভোক্তা দীপক হালদার বলেন, আমার যত টাকাই থাকুক, তিন হাজার টাকা দিয়ে তো একটা ইলিশ কেনা সম্ভব নয়। 

প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে তার নেতৃত্বে ছিলেন ইলিশ গবেষক ও মৎস্যবিজ্ঞানী ড. মো. আনিছুর রহমান। এই খ্যাতনামা ইলিশ বিশেষজ্ঞ বলেন, এবার ইলিশের দাম সত্যিই অস্বাভাবিক। এ দেশে ইলিশের প্রাচুর্য আছে। তারপরও এর এত দাম মেনে নেয়া যায় না। খুব দুর্ভাগ্যজনক।

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সহসভাপতি নাজির হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, এ বছর ইলিশের উৎপাদন কিছুটা কমেছে এটা ঠিক, কিন্তু যতটা না কমেছে তার চেয়ে দাম বেড়েছে বেশি। গত বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম বেড়েছে। বাজারে এখন আড়াই/তিন হাজার টাকায় মাছ বিক্রি হচ্ছে। আর এটা হয়েছে মধ্যস্বত্তভোগী-দাদন ব্যবাসয়ীদের কারসাজিতে। তাছাড়া ইলিশ মজুদ করে রাখা যায়, এটাও একটা কারণ।

গত ২১ জুলাই সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সরবরাহ কম থাকার পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও ডিজেলের দাম বেশি হওয়ার কারণে দেশে বর্তমানে ইলিশের দাম বেশি। এখন ইলিশের কেজি দুই হাজার টাকার ওপরে। সরবরাহ কম, এটা প্রধান কারণ। ঢাকায় ইলিশ এখনো সেভাবে আসেনি। আর চাঁদাবাজিও আছে, এটা এখনো বন্ধ করা যায়নি। তবে দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে ইলিশের দাম কমানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ইলিশের সরবরাহ

পটুয়াখালীর মহিপুর মৎস্য আড়ৎ সমবায় সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজু আহমেদ রাজা ভোরের কাগজকে বলেন, এই সময় ইলিশ উৎপাদনের মৌসুম হলেও মাছ পর্যাপ্ত ধরা পড়ছে না। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এবার কম ধরা পড়ছে ইলিশ। এর মধ্যে আবার ছোট আকারের মাছ বেশি ধরা পড়ছে; বড় আকারের মাছ একেবারেই কম। প্রজনন মৌসুমের এই সময়টাতে ট্রলার প্রতি ৮০-৯০ মণ মাছ ধরার প্রত্যাশা এবং তা হয়ও। কিন্তু এবার প্রতি ট্রলারে ধরা পড়ছে মাত্র ১০-১২ মণ। সরকারের নির্দেশনার কারণে জাল পাতলা (বড় ফাঁস) হওয়ায় ইলিশ কম ধরা পড়ছে। 

এবার ইলিশের দাম অনেক বেশি এ কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করে তিনি বলেন, ইলিশ কম ধরা পড়ার কারণে দাম বেশি। তবে পর্যাপ্ত ইলিশ ধরা পড়লে দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। আগামী ভাদ্র মাস থেকেই বেশি মাছ ধরা পড়বে বলে আশা করেন। 

ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করে এ বছর সামুদ্রিক মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞাকে ইতিবাচক মন্তব্য করে রাজু আহমেদ রাজা বলেন, নতুন অবরোধে উপকার হয়েছে। মাছের উৎপাদনে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে শতভাগ পালন করতে পারলে আরো ভালো হতো। পটুয়াখালী, বরগুনা ও কক্সবাজারসহ অন্যান্য এলাকায় অবরোধে জেলেরা মাছ ধরেনি। কিন্তু ভোলা জেলাসহ কয়েকটি এলাকায় অনেক মোকাম খোলা ছিলো। সেখানে জেলেরা অবরোধের সময় মাছ ধরেছে। তা না হলে ইলিশের উৎপাদন আরো বাড়ত। অবরোধের সময়টাতে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীসহ প্রশাসনের কঠোরতা আরো বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি। 

মহিপুর মৎস্য বন্দরের জেলে হাসান হাওলাদার বলেন, সাগরে প্রচুর ইলিশ আছে। কিন্তু সাগরে রাত বেড়ে যাওয়ায় জাল ফেলা যাচ্ছে না এবং রাতের তোড়ে জাল ছিড়ে যাচ্ছে। তবে যে ইলিশ ধরা পড়ছে তাতে খুব খুশি। আরেক জেলে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কিছু জেলে ট্রলিং ট্রলারে (সুক্ষ্ম ফাঁসের জালে মাছ ধরা ট্রলার) ইলিশ ধরছে। এতে প্রচুর একেবারেই ছোট ইলিশ বা জাটকা ধরা পড়ছে। বড় ইলিশ ধরা পড়ছে অনেক কম। ট্রলিং ট্রলার বন্ধ করতে পারলে বড় মাছ ধরা পড়বে, বেশি লাভবান হওয়া যাবে।

বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, কক্সবাজার, বরগুনা, ঝালকাঠি ও চট্টগ্রামের মতো উপকূলীয় জেলাগুলোতে বিপুল পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ে। এসব এলাকায় প্রায় এক দশক ধরে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে ইলিশের প্রজননের সময় মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা।

পাইকারী ও খুচরা দাম

পটুয়াখালীর মহিপুর মৎস্য আড়ৎ সমবায় সমিতির দেয়া তথ্য মতে, এই মুহূর্তে এক কেজির বেশি ওজনের একটি ইলিশ প্রতি মণ ৮৫ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা দরে পাইকারী বিক্রি হচ্ছে। আর ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলশের দাম ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার এবং ৪০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ইলিশের দাম ৪৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। 

এই হিসাবে, একটি এক কেজির ইলিশের দাম পড়ে ২১৭৫ টাকা (মণ ৮৭ হাজার টাকা ধরে), ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজির দাম পড়ে ১৬৭৫ টাকা এবং ৪০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের দাম পড়ে ১১৭৫ টাকা। এই মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে গেলে এবং খুচরা বাজারে দাম অনেক বেড়ে যায়। যেমন, রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে সোমবার অল্প পরিমাণে কিছু ইলিশ মাছ দেখা গেছে। কিন্তু জাটকা ও ছোট মাছই বেশি। ১১০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ২৪০০ টাকা হাঁকছেন বিক্রেতারা। দাম শুনে বেশিরভাগ ক্রেতাই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এমন একজন ক্রেতা স্বপ্ন মণ্ডল। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তার আয়-রোজগার অনেক কমে গেছে। তার ওপর এতো বেশি দাম দিয়ে ইলিশ মাছ কেনা দুঃস্বপ্নের মতো। 

ঢাকার খুচরা বাজারে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কিনতে গেলেও প্রতি কেজিতে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা লাগছে। বাজার ভেদে দামের তারতম্য হলেও চিত্র প্রায় একই। একটি বড় আকারের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকার ওপরে। তবে এর আগে জুলাই মাসে ইলিশের দাম ছিল আরো বেশি। তখন একটি বড় ইলিশের দাম ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রির খবর বেরিয়েছে। আকারভেদে এটি ৩ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠছে।

পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের দাম কম

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে ইলিশ ধরা পরে অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে বাংলাদেশের চেয়ে তা অনেকটাই কম। এবার বাংলাদেশের চেয়ে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের দাম তুলনামূলক কম। কলকাতায় ৫০০ গ্রামের একটি ইলিশের দাম ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫০ রুপি। বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৫০ টাকার মতো। 

অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে কেজিতে অন্তত ৪০০ টাকা কম। পশ্চিমবঙ্গের বাজারে ৭০০ গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশের কেজি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ রুপি (বাংলাদেশি ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা); এক কেজির ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ রুপির মধ্যে (বাংলাদেশি মুদ্রায় দাম ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে)।

কলকাতার মাছ আমদানিকারকদের সংগঠন ফিস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতুল দাস বলেছেন, এ বছর বঙ্গোপসাগর উপকূল এলাকায় ইলিশের সরবরাহ তুলনামূলক কম। তবু ইলিশের বাজার ঠিক রাখতে এই রাজ্যে মিয়ানমারের ইরাবতী নদীর ইলিশ আসছে। 

তিনি জানান, এক কেজির বেশি ওজনের এসব ইলিশ প্রতি কেজি ১৫০০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে গুজরাট ও মুম্বাই উপকূলের বড় আকারের (ওজন এক থেকে দুই কেজি) ইলিশ কিছুটা কম দামে প্রতি কেজি ১০০০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশের দাম তুলনামূলক চড়া ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ রুপি কেজি। তবে বাজারে বেশির ভাগই মিয়ানমারের ইলিশ।

পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের ইলিশের বিশেষ কদর আছে। প্রতি বছর বিপুল ইলিশ রপ্তানি হয়। আবার চোরাই পথেও যায়। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে যায়নি। তবে ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরা ইলিশ আমদানির অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। 

ইলিশের দাম নির্ধারণ কত দূর

ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে ও সারা দেশে একটি যুক্তিসঙ্গত মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে গত জুনের শেষ দিকে নির্দেশনা দেয়া হয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, নদী বা সাগরে ইলিশ উৎপাদনে জেলেদের কোনো খরচ নেই। প্রকৃত আহরণ ব্যয়ও কম। কিন্তু অসাধু, লোভী ব্যবসায়ী কিংবা সিন্ডিকেট বাজারে ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই সারা দেশের জন্য একটি যুক্তিসঙ্গত দাম নির্ধারণ করা হলে ফলপ্রসূ প্রভাব পড়বে। 

কিন্তু এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মৎস্য অণুবিভাগ) সৈয়দা নওয়ার জাহান ১১ আগস্ট ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর পরই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়েছে। বিষয়টি উপদেষ্টা মহোদয় স্পষ্ট করতে পারবেন। এর বেশি কিছু তিনি আর বলতে রাজি হননি। 

ভারত-বাংলাদেশে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞায় সমন্বয়

সামুদ্রিক মাছের অবাধ প্রজনন এবং জাটকা সংরক্ষণে বাংলাদেশের জলসীমায় জেলেদের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা আগে ছিল ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই। আর ভারতীয় জেলেদের জন্য ছিল ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত। এতে বাংলাদেশে জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সময় হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন, আর ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরার সুযোগ পেতেন। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন বাংলাদেশের জেলেরা। 

সেই দাবি মেনে নিষেধাজ্ঞার সময় নিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। চলতি বছর ভারতের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা চালু করা হয়। তবে তাতে লাভ হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি চোরাইপথে ভারতে ইলিশ পাচারেরও অভিযোগ করে আসছেন জেলারা। এর সত্যতাও মেলে। এ বছর এখন পর্যন্ত ইলিশ রপ্তানি করা হয়নি ভারতে। কিন্তু ভারতের কিছু ক্রেতাকে দেখা গেছে, ইলিশ কিনে ভিডিও ছাড়ছেন, আর তাতে ইলিশ দেখিয়ে বলছেন, ‘মাখন, মাখন। বরিশালের ইলিশ। বাংলাদেশের ইলিশ’।

এছাড়া অক্টোবরের ১১ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এই নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। দেশের ইলিশ রক্ষায় সরকার প্রতি বছর কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ সময়ে সরকার জেলেদের ইলিশ মাছ না ধরতে প্রণোদনা ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে থাকে। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন অভয়াশ্রম এলাকাগুলোতে প্রশাসনের সহযোগিতায় অভিযান চালায় মৎস্য বিভাগ। এই নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশের অভয়াশ্রমে মাছ ধরা, পরিবহন, বিক্রি ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 

সরকার বলছে, ওই সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। একটি মা ইলিশ চার থেকে পাঁচ লাখ ডিম ছাড়ে। এই ডিম রক্ষা করতে পারলে তা নিষিক্ত হয়ে জাটকার জন্ম হবে। সেই জাটকা রক্ষা করা গেলে দেশে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। কেউ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশ মাছ ধরলে মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উভয় দণ্ড দেয়ার বিধানও রয়েছে। নির্দিষ্ট নিয়মগুলো জেলেরা মানলে ইলিশ মাছ উৎপাদন বাড়বে বলে মনে করছেন গবেষকরা। ইলিশ মাছ আহরণের সময় বেশ কিছু বিষয় অনুসরণের জন্য মৎস্য বিভাগ থেকে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।

ইলিশের অভয়াশ্রম এবং প্রজনন কেন্দ্র

প্রজনন শুরু হলে ইলিশ ঝাঁক বেধে সাগর থেকে মিঠা পানির নদীতে চলে আসে। দেশে ইলিশের চারটি প্রজনন ক্ষেত্র এবং ছয়টি অভয়াশ্রম আছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর-এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। 

এর বাইরের উপকূলের অন্যান্য নদীগুলোতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে। ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও তার অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলায় মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা, তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা অন্যতম। এছাড়া পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকাও এর ভেতরে পড়ে। 

বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম

সুস্বাদু হিসেবে বাংলাদেশের ইলিশ মাছের সুখ্যাতি রয়েছে সারা বিশ্বে। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম। ৮৬ শতাংশ ইলিশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় এক শতাংশ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। ইলিশ সম্পদের উন্নয়নে সরকার সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করায় উৎপাদন আশাতীতভাবে বেড়েছে। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন উদ্বেগজনকভাবে কমে ১ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন হয়েছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের আহরণ ছিল ২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন। তবে চলমান বছরে ইলিশের উৎপাদন পৌনে ৬ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছাবে বলে আশা করছেন মৎস্য কর্মকর্তা এবং মৎস্যবিজ্ঞানী ও গবেষকার। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, এ বছর জেলেরা যথেষ্ট প্রোটেকশন পেয়েছে সরকারের তরফ থেকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

বিদেশে পাচার করা ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির সন্ধান

বিদেশে পাচার করা ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির সন্ধান

দেশ যেন মৌলবাদের অভয়ারণ্য না হয়: তারেক রহমান

দেশ যেন মৌলবাদের অভয়ারণ্য না হয়: তারেক রহমান

পাম তেল কতটা স্বাস্থ্যকর?

পাম তেল কতটা স্বাস্থ্যকর?

অটোগ্রাফ জাল: নতুন বিপদে শাহরুখ, সালমান ও হৃতিক

অটোগ্রাফ জাল: নতুন বিপদে শাহরুখ, সালমান ও হৃতিক

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App