×

জাতীয়

লাগামহীন রাসায়নিক গুদাম

Icon

আজিজুর রহমান জিদনী

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০০ পিএম

লাগামহীন রাসায়নিক গুদাম

ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম ও পোশাক কারখানায় আগুনে ১৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ফের স্মরণ করিয়ে দিল ঢাকা এখনো রাসায়নিকের গুদামের ঝুঁকিতে। নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পরও অবৈধ রাসায়নিক কারখানার লাগাম টেনে ধরা যায়নি। উল্টো ফায়ার সার্ভিস বলছে, মিরপুরের রূপনগরে আগুন লাগা রাসায়নিক গুদামের আশপাশে এমন আরো অনেক এমন গুদাম রয়ে গেছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২০১০ সালে নিমতলীতে ১২৪ জনের প্রাণহানি কিংবা ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ৭১ জনের মৃত্যুর পরও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঝুঁকি সম্পর্কে সবাই জানলেও রাজধানীর আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে অবৈধ রাসায়নিকের গুদাম এবং অনুমোদনহীন স্থাপনার কার্যক্রম চলছেই।

তারা বলছে, দেশের অধিকাংশ এ ধরনের উৎপাদন বা বিপনন প্রতিষ্ঠান একটা মৃত্যুফাঁদ। আর এ ফাঁদ তৈরিতে নজরদারির দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দায়ী। যতদিন পর্যন্ত আমরা এই নিয়মের চেইন-অ্যাকশন প্রতিষ্ঠিত করতে না পারব, এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। 

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩ সালে দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭৯২ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ১০২ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর ২৬ হাজার ৬৫৯টি ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু ও ৩৪১ জন আহত হন। আর চলতি বছরের গত ৭ মাসেই এ ধরনের ঘটনায় ১৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তদন্তকারী বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছেন, শুধু পুরান ঢাকাতেই প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক গুদাম রয়েছে, যার মধ্যে ১৫ হাজারই আবাসিক ভবনে অবস্থিত।

আরো পড়ুন : রূপনগরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত বেড়ে ১৬

অতীতে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ বা স্থানান্তরের জন্য সরকারিভাবে বেশ কয়েকবার অভিযান শুরু হয়েছিল। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মাঝপথে থেমে গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০১৯ সালে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলেও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অনুরোধে তা স্থগিত করে। পরে আর উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়নি। গত ২০১০ সালের নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারি কমিটি আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম অপসারণসহ ১৭টি সুপারিশ করেছিল। কিন্তু এর কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এবং ফাইলটি ১৬ বছর ধরে ধামাচাপা পড়ে আছে।

২০১৯ সালে চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডির পর ফায়ার সার্ভিস ফের আবাসিক ভবনে রাসায়নিক গুদাম নিষিদ্ধ করা, পুরান ঢাকার সরু গলি অন্তত ২০ ফুট চওড়া করা ও নির্দিষ্ট দূরত্বে রাস্তার পাশে হাইড্রেন্ট স্থাপনের মতো জরুরি পদক্ষেপের সুপারিশ করে। সেই সুপারিশগুলোও ফাইলবন্দিই রয়ে গেছে।

লালবাগের অনেক জায়গাতেই এখনো দেখা মিলে প্লাস্টিক তৈরির মহাযজ্ঞ। বিভিন্ন কারখানার কর্মচারীরা বলছেন, আবাসিক এলাকায় এরকম কারখানা দেয়া যায় না। তবে লালবাগ প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে কারখানা আছে। টিকাটুলির মামুন প্লাজাতেও দেখা যায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একই ভবনের উপরে আবাসিক ও নিচে রাসায়নিকের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। শুধু এই এক ভবন নয়; পুরান ঢাকার প্রায় অনেক ভবনেরই একই দশা। তবে এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে সেখানকার ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়তে হয়।

তারা বলেন, এখানে বাইরের মানুষ আসে না। রাসায়নিক আসে, আবার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শুধু ঢাকা নয় গাজীপুরের অলিগলিতে নিয়ম বহিভূর্তভাবে গড়ে উঠেছে রাসায়নিক গুদাম। আবাসিক এলাকায় দাহ্য পদার্থের গুদাম ও দায়সারা লাইসেন্স প্রক্রিয়ার কারণে এই শিল্পাঞ্চল এখন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। অথচ গুদামগুলো সরিয়ে নিতে শত কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক রাসায়নিক ওয়্যারহাউস নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার, যা এখনো খালি পড়ে আছে। এমন বাস্তবতায় নীতিনির্ধারণী সব দপ্তরকে সমন্বিত উদ্যোগের পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। 

গাজীপুরের ক্যাপরি সিনেমা হল। এক সময়ের জমকালো এই হলটিই এখন রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের দখলে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এখানে মজুত করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য। কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই চলছে রাসায়নিক আনা-নেয়ার কাজ। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরেই আছে ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। গুদামে কাজ করা কয়েকজন কর্মী জানান, এখানে ৭-৮ ধরনের রাসায়নিক আছে। তবে কোনো একটি গ্যাস সিলিন্ডার বা গ্যাস স্টেশনে আগুন ধরলে তার মানে এই নয়, সারা বাংলাদেশে গ্যাস বন্ধ হয়ে যাবে। হয়তো সম্প্রতি এক জায়গায় একটি দুর্ঘটনা ঘটছে। আর যেটি তারা ব্যবহার করছে, তা সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের আইটেম।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক কর্মকর্তা এবং অগ্নি ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ এ কে এম শাকিল নেওয়াজ ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের অধিকাংশ এ ধরনের উৎপাদন বা বিপণন প্রতিষ্ঠান একটা মৃত্যুফাঁদ। আর এ ফাঁদ তৈরিতে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দায়ী। কারণ সাধারণত ব্যাংক, বিমা, সিটি করপোরেশন, রাজউক, কলকারখানা অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শ্রম মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসের মতো তদারকি প্রতিষ্ঠান ও ক্ষেত্র বিশেষে জেলা প্রসাশনের অনুমতি প্রাপ্তি সাপেক্ষে নানা ধাপ পেরিয়ে একটি উৎপাদন বা বিপণন প্রতিষ্ঠান খুলতে হয়। এখন যদি ধরে নেই মিরপুরের যে প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল, তারা সব রকমের শর্ত পূরণ করেই কারখানা গড়ে তুলেছিল। এটাইতো আইনগত প্রক্রিয়া। তাহলে ১৬ জনের প্রাণ হারানোর ঘটনা একটি নিছক দুর্ঘটনা হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা কী দেখলাম?

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, অগ্নিদগ্ধ প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছিল না, ছিল না অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা। এছাড়া ছাদের দরজায় তালা ছিল। মিরপুরে রূপনগর আবাসিক এলাকার যেখানে রাসায়নিকের গুদামটির অবস্থান ছিল; এর ঠিক সামনেই ছিল পোশাক কারখানা। আশপাশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রসহ আরো বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা ছিল। এখনো পুড়ে যাওয়া রাসায়নিক গুদামের আশপাশে এমন আরো গুদাম রয়েছে বলে জানা গেছে। এখানে কীভাবে রাসায়নিক গুদাম প্রতিষ্ঠিত হলো? তা হলে বলতে হবে, অনেকের চোখ এড়িয়ে বা ম্যানেজ করেই প্রতিষ্ঠানগুলো চলে আসছিল। তাহলে এর দায় সংশ্লিষ্ট সবার ওপরেই তো বর্তায়। একটি প্রতিষ্ঠানও কী সেখানে ফুলস্টপ বলেছে, না বন্ধ করো এবার। এমনকি ওই এলাকার সাধারণ মানুষসহ পেশাজীবী বা স্থানীয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা কি দ্বায়িত্ব পালন করেছে?

এসব কারখানা বন্ধে মানববন্ধন বা সংশ্লিষ্ট কারো কাছে অভিযোগ করেছেন? তারা কি দায় এড়াতে পারেন? তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, তাহলে দায় নেই কার? একটি বিষয় হলো, মালিক পক্ষের কারো এসব ঘটনায় কিছু হয় না। প্রাণ যায় শুধু সাধারণ গরিব মজদুরদের। আর তাদের জীবনের মূল্য ২-৩ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ। যতদিন পর্যন্ত আমরা এই নিয়মের চেইন-অ্যাকশন প্রতিষ্ঠিত করতে না পারব, এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। 

মিরপুরে রাসায়নিক গুদামের বিষয়ে গতকাল সমাজকল্যাণ ও মহিলা এবং শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, আমি ঘটনাস্থল দেখতে এসেছি। এ ধরনের রাসায়নিক যেখানে রাখা হয়, এগুলো হচ্ছে বেআইনি জায়গা। আমি মনে করি, প্রথম যে জিনিসটি করতে হবে, সরকারকে ইমিডিয়েট ইনভেস্টিগেশন করতে হবে। যারা এটা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে ও আমাদের স্ট্রং পলিসি থাকতে হবে। যেন জনবহুল এলাকায় এ ধরনের ক্ষেত্রগুলো না থাকে।

তিনি বলেন, আপনারা জানেন এর আগেও পুরান ঢাকায় এরকম ঘটনা ঘটেছে। যেহেতু সেটা একটি জনবহুল এলাকা, সে কারণে ওই জায়গা থেকে রাসায়নিক সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে যেটা হয়েছে, প্রাইভেট এই ক্ষেত্রগুলো বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। এটা চিহ্নিত করে আমাদের অতিসত্বর জরুরিভাবে এগুলোকে উৎখাত করা দরকার; যাতে জনবহুল এলাকা থেকে এগুলো বের হয়ে যায়। যদি পলিসি পরিবর্তন করা দরকার হয় তাহলে সেটাই করতে হবে।

উল্লেখ্য, এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর সাহারা মার্কেট এলাকার একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগে। প্রায় ১ ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের তিনজন কর্মী ও পার্শ্ববর্তী দোকানের একজন কর্মচারীসহ পাঁচজন অগ্নিদগ্ধ হন। তাদের উদ্ধার করে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন, টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার ওয়্যারহাউস পরিদর্শক খন্দকার জান্নাতুল নাঈম, ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদ ও নুরুল হুদা এবং পার্শ্ববর্তী দোকানের কর্মচারী মো. আল আমিন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

চট্টগ্রাম ইপিজেডে কারখানায় ভয়াবহ আগুন, নিযন্ত্রণে ১৬টি ইউনিট

চট্টগ্রাম ইপিজেডে কারখানায় ভয়াবহ আগুন, নিযন্ত্রণে ১৬টি ইউনিট

পল্লবী থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন নজরুল ইসলাম নাজু

পল্লবী থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন নজরুল ইসলাম নাজু

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিশ্ব মেরুদণ্ড দিবস উদযাপন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিশ্ব মেরুদণ্ড দিবস উদযাপন

ভুলত্রুটি ছাড়াই ফল প্রস্তুত হয়েছে: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক

ভুলত্রুটি ছাড়াই ফল প্রস্তুত হয়েছে: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App