ব্যর্থতা এবং সাফল্য
ব্যক্তির অর্জন অস্থায়ী কিন্তু সমাজের জন্য দীর্ঘস্থায়ী
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৪ পিএম

ব্যক্তির অর্জন অস্থায়ী কিন্তু সমাজের জন্য দীর্ঘস্থায়ী
মানবজীবনে সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোই অবশ্যম্ভাবী। কেউই কেবল সাফল্যের মধ্য দিয়ে জীবন পার করে না, আবার কেবল ব্যর্থতার অন্ধকারেও জীবন আটকে থাকে না। বাস্তবে এগুলো একে অপরকে পরিপূরক করে চলে। ব্যর্থতা মানুষকে শেখায়, আর সাফল্য দেয় সাময়িক আনন্দ ও আত্মবিশ্বাস। কিন্তু উভয়ই অস্থায়ী—কারণ সময়, পরিস্থিতি, সামর্থ্য ও ভাগ্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছু রূপান্তরিত হয়। তাই ব্যর্থতা কিংবা সাফল্যের প্রতি চিরস্থায়ী মোহ বা ভয় কোনোটাই মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।
ব্যর্থতার তাৎপর্য হলো—এটি মানুষকে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে সাহায্য করে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কিংবা ব্যবসায়িক সফলতার পেছনে অসংখ্য ব্যর্থ প্রচেষ্টা থাকে। ব্যর্থতা ধৈর্য, সহনশীলতা এবং স্থিতিশীল মনোভাব গড়ে তোলে। এটি মানুষকে বিনম্র করে, যাতে তারা নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা গ্রহণে উন্মুক্ত থাকে।
অন্যদিকে সাফল্য আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি দেয়। এটি কেবল অর্জনকারী নয়, তার আশেপাশের মানুষকেও অনুপ্রাণিত করে। সাফল্যের মাধ্যমে সমাজে নতুন সুযোগ ও উন্নয়নের পথ তৈরি হয়।
অস্থায়িত্বের কারণও স্পষ্ট। পরিবর্তনশীল সময়ে যে সাফল্য আজকের দিনে গৌরবের, তা আগামী দিনে প্রাসঙ্গিক নাও থাকতে পারে। যেমন, প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে পুরনো সাফল্য দ্রুত অচল হয়ে যায়। মানুষ ক্ষণস্থায়ী; তাই তার অর্জনও সময়ের সাথে হারিয়ে যায়। আবার যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি মুহূর্তেই সাফল্যকে ব্যর্থতায় রূপান্তর করতে পারে।
সাফল্য এবং ব্যর্থতা আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ। ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ছাড়া সাফল্যকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় না। আবার কেউ যদি সাফল্যে স্থির হয়ে যায় তবে অহংকার জন্ম নেয়; আর ব্যর্থতায় ডুবে গেলে হতাশা গ্রাস করে। তাই এ দুটিকে অস্থায়ী ভেবে গ্রহণ করতে পারলেই মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা যায়।
মানবকল্যাণের ক্ষেত্রে এই দুই অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যর্থতা থেকে শেখা জ্ঞান এবং সাফল্য থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা মিলেই মানবজাতির অগ্রগতির সোপান তৈরি করে। মানুষ যদি বুঝতে পারে সাফল্য বা ব্যর্থতা স্থায়ী নয়, তবে তারা বর্তমানকে মূল্যায়ন করবে এবং জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে। ব্যর্থতাকে স্বাভাবিক ধরা হলে অন্যের কষ্টকে সহজে উপলব্ধি করা যায়, যা সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করে। সমাজ যখন ব্যর্থতাকে শিক্ষা আর সাফল্যকে সাময়িক ধাপ হিসেবে দেখে, তখন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও মানবকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন সহজ হয়।
ইতিহাসও প্রমাণ করে—অর্জনের মূল্যায়ন সময়ের সাথে বদলে যায়। ১৯৩০–৪০-এর দশকে অ্যাডলফ হিটলারের রাজনৈতিক ক্ষমতা জার্মানিতে এক বিশাল সাফল্যের প্রতীক ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংস, গণহত্যা এবং মানবিক বিপর্যয় তাকে আজকের দিনে এক অন্ধকার স্মৃতিতে পরিণত করেছে। হিটলার নেই—কিন্তু তার কর্মের স্মৃতি আজও বিশ্ববাসীর কাছে এক অভিশাপের প্রতীক। প্রশ্ন জাগে—তখন সেটা তার কাছে সাফল্য ছিল, নাকি ব্যর্থতা?
আবার ১৮৬৭ সালে আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করে শিল্পোন্নয়ন ও প্রযুক্তির জগতে বিপ্লব ঘটান। এটি নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের এক বড় হাতিয়ার ছিল। কিন্তু একইসাথে ডিনামাইট সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়ে ধ্বংসযজ্ঞেরও কারণ হয়েছে। নোবেল বেঁচে নেই—কিন্তু তার আবিষ্কার টিকে আছে, আর তার নামে প্রতিষ্ঠিত নোবেল পুরস্কার আজও মানবকল্যাণে অবদান রাখছে। এখানে সাফল্য ও ব্যর্থতা পাশাপাশি হাঁটছে।
ব্যর্থতা এবং সাফল্য দুটোই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, তবে কোনোটাই ব্যক্তির জন্য স্থায়ী নয়; তবে কখনও কখনও এগুলোর প্রভাব আমাদের মৃত্যুর পরও সমাজ ও ইতিহাসে থেকে যায়। এগুলো মানুষকে শিক্ষা দেয়, অনুপ্রেরণা জোগায়, আবার সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাসের প্রতিফলন আমাদের শেখায়—একজন মানুষের জীবদ্দশার সাফল্য পরবর্তীকালে ব্যর্থতার প্রতীকও হতে পারে, আবার ব্যর্থতার ভেতর থেকেও মানবকল্যাণের আলো উদ্ভাসিত হতে পারে।
তাই জীবনের আসল সার্থকতা হলো ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং সাফল্য থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে মানবকল্যাণে কাজ করা। স্থায়ী নয় বলেই এগুলো আমাদের গতিশীল রাখে, নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার শক্তি জোগায়।
“সাফল্য ও ব্যর্থতা ব্যক্তির কাছে সাময়িক, কিন্তু তার কর্মের প্রতিধ্বনি সমাজ ও ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী—যা কখনো মানবকল্যাণের আলো জ্বালায়, আবার কখনো ধ্বংসের অন্ধকার ছড়ায়।”
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন), [email protected]