জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব: দুই প্রজন্মের নেতৃত্বে নতুন স্বপ্ন

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ০২:১০ এএম

জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব: দুই প্রজন্মের নেতৃত্বে নতুন স্বপ্ন
বাংলাদেশ আজ একটি কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দলে দলে বিভক্ত নেতৃত্ব, আত্মসাৎ করা গণতন্ত্র, দুর্নীতির অতল গহ্বর—সবকিছু মিলিয়ে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমন মুহূর্তে প্রয়োজন একটি সাহসী, গ্রহণযোগ্য ও ঐতিহাসিক রূপরেখা—যা আমাদের জাতিকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখাবে।
দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন কার্যত দলে কোণঠাসা, বিপরীতে মাঠ পর্যায়ে কর্তৃত্ব দখল করেছে এমন এক সিনিয়র নেতা চক্র যারা তারেক রহমানের আদর্শ বা নেতৃত্বকে বিশ্বাস করে না। এই চক্রের সঙ্গে মিশে আছে ভারতের ছায়া, হানিট্র্যাপ এবং আওয়ামী শাসনামলের সুযোগ-সুবিধা গ্রহীতারা। মাঠ পর্যায়ে এই নেতারা তারেক রহমানের অভিপ্রায়, ভাষণ, পরিকল্পনা—কোনোটিই বাস্তবায়ন করছে না। বরং তাদের উগ্রতা, দম্ভ ও কূটকৌশলে আজ বিএনপি পরিণত হয়েছে এক বি-টিমে, আওয়ামী লীগের বিকল্প মুখোশধারী শক্তিতে। জাতি দেখছে, বুঝছে এবং হতাশ।
তবে হতাশার মাঝেই দেখা যাচ্ছে নতুন আশার আলোকছটা—জাতীয় সরকার গঠনের একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত নাগরিক মতবিনিময় সভায় প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করা হয়েছে এই প্রস্তাব—অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের রূপরেখা, যার মূল কাণ্ডারি হবেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তারেক রহমান।
এই সরকারের মেয়াদসীমা সর্বোচ্চ ১৮ থেকে ২৪ মাস। এই সময়ের মধ্যে কোনো জাতীয় নির্বাচন হবে না। বরং চলবে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তুতি, প্রশাসন ও রাজনীতির depoliticization এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি হবেন ড. ইউনূস—একজন নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত, সাহসী ও মানবিক ব্যক্তিত্ব। আর প্রধানমন্ত্রী হবেন তারেক রহমান—জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরসূরি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীক এবং জনগণের প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু।
এই অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন কাঠামো হবে সর্বদলীয়, যেখানে থাকবে বড় রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সমাজ, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব। মন্ত্রী পরিষদে দায়িত্ব ভাগাভাগি হবে প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে উপ-রাষ্ট্রপতি মিলেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সমন্বিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলবে। সরকারের মূল দায়িত্ব হবে দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং একটি জনগণের সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া শুরু করা।
এই প্রেক্ষাপটে জামাতসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। তারা দেশের পরিকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ও কাজ করে আসছে। তাদের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা ও ভূমিকা অবশ্যই মান্যতা পাওয়ার যোগ্য এবং এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিচালনায় তাদের উপস্থিতি প্রয়োজন। জাতীয় পুনর্গঠন কোনো একক গোষ্ঠীর দ্বারা সম্ভব নয়—সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংলাপে এনে দেশের জন্য কাজ করতে হবে।
এনসিপি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের এই আন্দোলন ও সংগ্রাম নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপনে এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তাদের অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক ত্যাগকে রাষ্ট্র গঠনে কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি। এনসিপিসহ সকল জাতীয়তাবাদী, ইসলামী ও গণমুখী ধারার প্রতিনিধিত্ব অন্তর্ভুক্ত করেই হতে হবে একটি সুষ্ঠু, স্থিতিশীল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এই সংকটপূর্ণ সময়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান রক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জনস্বার্থে নিরপেক্ষভাবে অবস্থান নেওয়া—এটাই তাদের কর্তব্য। তারা রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করবে, যাতে অন্তর্বর্তী সরকার নিঃশঙ্কভাবে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারে। সামরিক বাহিনীকে একটি জবাবদিহিমূলক, সংবিধাননিষ্ঠ, সুশৃঙ্খল ও শান্তির বাহিনী হিসেবে জাতীয় ঐক্যের রক্ষাকবচ হতে হবে।
এই মুহূর্তে আমাদের রাষ্ট্রকে প্রয়োজন এমন এক কাঠামো, যেখানে দলীয় ছত্রছায়ায় চলা দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের অবসান ঘটানো যাবে। যেখানে গণতন্ত্র কেবল ভোটাধিকারেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং নীতি, নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে রাজনীতি মানে হবে শোষণ নয়, সেবা। এই লক্ষ্যেই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ডাক দেওয়া হচ্ছে।
আজকের প্রজন্ম দুর্নীতির ভারে নুয়ে পড়া রাষ্ট্র চায় না। তারা চায় সততা, উদ্ভাবন, ন্যায়বিচার আর আত্মমর্যাদার বাংলাদেশ। এই নতুন প্রজন্মের জন্য, একটি নিরপেক্ষ, স্বল্পমেয়াদী এবং সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকারই একমাত্র কার্যকর পথ হতে পারে। জনাব তারেক রহমানের প্রতি আহ্বান—আপনি মায়ের পথ অনুসরণ করুন। দৃঢ় হোন। যারা আপনার বিশ্বাস ভেঙেছে, তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় দিন। দল পুনর্গঠনে সাহসী হোন। জাতীয় ঐক্যের নতুন ভিত্তি তৈরি করুন। জাতি আজও আপনার দিকে তাকিয়ে। আপনি ফিরে আসুন, রাষ্ট্র গড়ার এই ঐতিহাসিক দায়িত্বে নেতৃত্ব দিন।
এটি কেবল সময়ের ডাক নয়, এটি ইতিহাসের অনিবার্য বাস্তবতা। যদি জাতি আবার জেগে উঠে, তবে তা হবে এই অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্য দিয়েই—যার রাষ্ট্রপতি হবেন ড. ইউনূস, প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান। এই রাষ্ট্র হবে জনগণের, ভবিষ্যতের, নতুন প্রজন্মের। এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে নাগরিক সমাজ, ছাত্র-জনতা ও দেশপ্রেমিক প্রশাসনিক অংশের একটি ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]