জাতীয় কলঙ্কের নতুন অধ্যায়
জনগণের বিশ্বাস ভেঙে নির্মিত নিষ্ক্রিয়তার সাম্রাজ্য
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ০৪:৩৭ এএম

জনগণের বিশ্বাস ভেঙে নির্মিত নিষ্ক্রিয়তার সাম্রাজ্য
নির্ভরতা ও গভীর বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে কেউ যখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়, তখন তার প্রতিটি পদক্ষেপে জনগণের স্বপ্ন, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার প্রতিচ্ছবি থাকা উচিত। কিন্তু যখন সেই বিশ্বাস চূর্ণ হয়, তখন তা শুধু হতাশা নয়—একটি জাতির আত্মবেদনার ইতিহাসে পরিণত হয়। এই লেখার শুরুতেই আমি সেই গভীর ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছি, যা আজকের বাস্তবতায় এক ভয়াবহ রাজনৈতিক ও নৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
যখন দেশজুড়ে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, এবং অযোগ্যতার রাজত্ব চলছে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত দখলদারির সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে—ঠিক তখনই ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার যেন এক নিষ্ক্রিয়তার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে। দেশের সাধারণ মানুষ, যারা রক্ত ও আত্মত্যাগে এই রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণ করেছে, তারা পেয়েছে এক ভয়াবহ প্রতিদান ‘শাপ ছেড়ে খেলা দেখার’ মতো নির্বিকার প্রশাসনিক দর্শন।
রাষ্ট্র রক্ষার দায়িত্ব যাদের, সেই বেতনভুক্ত সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি তারা যখন ছায়ার মতো পেছনে, তখন এই দেশের রাস্তায় ১৪০০ (আনুমানিক ১,৪০০ জন নিহত হওয়ার তথ্য জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যা একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উৎস) সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছে। অথচ আজ তারাই প্রান্তিক, তারাই অবহেলিত। উপভোগ করছে এক বিদেশী অনুগত, সুবিধাভোগী এলিট গোষ্ঠী যাদের সাথে এই মাটির ঘামের, রক্তের কিংবা আত্মত্যাগের কোনো সংযোগই নেই। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যাদের বসানো হয়েছে, তারা অনেকেই বিদেশি গ্রিনকার্ডধারী, দেশের মাটির চেয়ে বিদেশি ক্ষমতার কাছে বেশি অনুগত।
প্রশ্ন জাগে ড. ইউনূস কি সেই সাধারণ মানুষদের কথা ভুলে গেছেন, যারা চোখের জল ফেলে এই রাষ্ট্রকে রক্ষা করেছিল? নাকি এই নিষ্ক্রিয়তা, এই নীরবতা আসলে এক সুপরিকল্পিত প্রতারণা, যার উদ্দেশ্য ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা এবং জাতিকে পণ্য করে আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে তুলে দেওয়া?
একটি গণজাগরণ হয়েছিল শুধু একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি নষ্ট, দখলদার, দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে। হাজারো তরুণ, শ্রমজীবী, সাধারণ মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল একটি ন্যায্য ও মানবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রত্যাশায়। কিন্তু আজ, সেই আন্দোলনের ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি এক নিষ্ক্রিয় সরকার, যেটি জনগণের জীবন, সম্মান ও ভবিষ্যৎকে বারবার অপমান করেছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকার একরকম ‘শাপ ছেড়ে খেলা দেখা’র দর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে চাঁদাবাজি, অযোগ্যতা, প্রশাসনিক দখলদারি, ও মব সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি স্তরে।
প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ও রাষ্ট্রপতি যাদের নিরপেক্ষ থাকা উচিত ছিল, তারা নিজেদের রক্ষাকবচ বানিয়ে ফেলেছে আগের সরকারে গড়ে ওঠা সুবিধাবাদী অবস্থানকে। প্রশাসনের প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মী শেখ হাসিনার শাসনামলে সুবিধাভোগী হয়ে পড়ায় নতুন সরকারেও তারা নিষ্ক্রিয়, অনুগত ও ক্ষমতা-বান্ধব আচরণ করছে। রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক বাহিনী কখনো নিরপেক্ষতার ভান করে, কখনো সরাসরি সিদ্ধান্তে অংশ নিয়ে ক্ষমতার ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এটা জনতার সঙ্গে এক নিষ্ঠুর প্রতারণা।
বিএনপি নিজেকে সরকারবিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারত, কিন্তু তাদের অপারগতা, নেতৃত্বহীনতা, এবং নির্লজ্জ ক্ষমতালিপ্সু আচরণ আজ তাদের একটি হাস্যকর বিকল্পে পরিণত করেছে। জামায়াত কৌশলে টিকে থাকলেও, জাতির নেতৃত্ব দেওয়ার নৈতিকতা তাদের নেই। অন্যদিকে, নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব ছাত্র আন্দোলনের তরুণেরা ক্ষমতা ও অর্থের লোভে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তারা এখন টেন্ডারবাজি, বদলি বাণিজ্য ও মাস্তানির প্রতীক।
ড. ইউনূস যেভাবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল মানুষের আশা ও বিশ্বাসের উপর দাঁড়ানো। কিন্তু তাঁর সরকার আজ দাঁড়িয়ে আছে একরোখা, প্রতিহিংসাপরায়ণ, আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তাঁর নীতিনির্ধারণে দেখা গেছে: সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যবহার ও বিপরীত পথে হাঁটা; বিদেশি করিডোর ও বন্দর হস্তান্তর করে দেশের নিরাপত্তা বিপন্ন করা; নবীন আন্দোলনকারীদের সরাসরি প্রশাসনে এনে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি; মব সংস্কৃতিকে বৈধতা দিয়ে বিচারব্যবস্থাকে ক্ষয় করা; প্রতিশ্রুত সাংবিধানিক সংস্কারকে এড়িয়ে গিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভবন; বিদেশি গ্রিনকার্ডধারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব খর্ব করা; দুর্নীতিগ্রস্ত উপদেষ্টাদের দিয়ে সরকার পরিচালনা; এবং পদত্যাগ নাটকের মাধ্যমে জনগণের আবেগ নিয়ে খেলা।
বর্তমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে এখন সময় এসেছে বাস্তবসম্মত, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সংস্কার ও বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপনের। সংবিধান সংস্কারে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন গঠন প্রয়োজন, যাতে দলীয় হস্তক্ষেপ সম্ভব না হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার বিপরীতে সংসদ ও রাষ্ট্রপতির ভূমিকা স্পষ্ট করে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আইনের নামে নিপীড়ন বন্ধ হয়।
সেনাবাহিনীকে সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখার আইন প্রণয়ন জরুরি। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও ভূমিকা নির্ধারণ করে তাঁকে প্রতীকী না রেখে সংকটকালে ভারসাম্যকারী শক্তিতে পরিণত করতে হবে। সামরিক বাজেট ও সিদ্ধান্তের ওপর সংসদীয় নজরদারি চালু করা উচিত।
বিকল্প সুশাসনের জন্য দরকার দক্ষ, স্বচ্ছ ও জনঅংশগ্রহণভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে এবং রাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা কমাতে হবে। নিয়োগ ও পদায়নে যোগ্যতা, দক্ষতা ও নৈতিকতা হতে হবে মূল মানদণ্ড।
যে বিপ্লবের শুরু হয়েছিল একটি ন্যায্য রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে, তা আজ স্বার্থ, প্রতারণা ও নির্বিকার নিষ্ক্রিয়তার বলয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণ শুধু আরেকটি নির্বাচন দিয়ে সম্ভব নয়; এর জন্য দরকার একটি বিবেকের বিপ্লব যেখানে মানুষ নেতৃত্ব পাবে নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা ও জনসেবার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে।
ড. ইউনূস বা তাঁর আশেপাশের এলিটরা হয়তো বিদেশে চলে যাবেন, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে এই ধ্বংসস্তূপেই বাঁচতে হবে। আমাদের প্রজন্ম যদি এই প্রজন্মের ভুল না শুধরে, তবে পরবর্তী ইতিহাসেও আমরা হয়ত পড়ব সেই চিরন্তন লাইনটি “বিপ্লব তার সন্তানদেরই গ্রাস করে।”
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]