×

মুক্তচিন্তা

তুলার ভূ-রাজনীতি: মার্কিন আমদানির দিকে কেন ঝুঁকছে বাংলাদেশ?

Icon

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৫৮ পিএম

তুলার ভূ-রাজনীতি: মার্কিন আমদানির দিকে কেন ঝুঁকছে বাংলাদেশ?

মার্কিন আমদানির দিকে কেন ঝুঁকছে বাংলাদেশ? জানিয়েছেন সাইফুল ইসলাম শান্ত

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। কিন্তু পোশাক শিল্পের মূল কাঁচামাল তুলা বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় খুব সামান্য পরিমাণে। বিপুল চাহিদা মেটাতে আমাদের নির্ভর করতে হয় আমদানির ওপর। দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকা, ভারত ও ব্রাজিল ছিল তুলা আমদানির প্রধান উৎস। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও কিছুটা তুলা আসত, তবে তা ছিল সীমিত। সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। ট্যারিফ সুবিধা আদায়ে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে মার্কিন তুলা আমদানির দিকে ঝুঁকছে।

দেশের ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর ৭.৫ থেকে ৮.২ মিলিয়ন বেলস তুলা আমদানি করে। এর মধ্যে সর্বাধিক আসে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। এসব দেশের মধ্যে বুর্কিনা ফাসো, মালি, বেনিন ও আইভরি কোস্টের মতো দেশগুলো মিলিয়ে প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ তুলা জোগান দেয়। ব্রাজিল আরেকটি বড় উৎস, দেশটি থেকে প্রায় ২০ শতাংশ তুলা আসে। প্রতিবেশী ভারত থেকেও দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ১৮-২০ শতাংশ তুলা আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান থেকেও তুলা আমদানি করা হয়।

গুণমানে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা শীর্ষস্থানীয় হলেও বাংলাদেশে এর আমদানির অংশ এখনো সীমিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানির অংশ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল প্রায় ৯ শতাংশ, যেখানে কয়েক বছর আগে এই হার ছিল ১০-১১ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধে এ হার আরও কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ শতাংশে। তবে পরিস্থিতি পরিবর্তনের পথে। বাণিজ্যিক সুবিধা ও রাজনৈতিক সমীকরণ বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে মার্কিন তুলার দিকে টানছে।

প্রথমত, বাণিজ্য সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার। মার্কিন তুলা ব্যবহার করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করলে ট্যারিফে উল্লেখযোগ্য ছাড় পাওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের আওতায় ৩৭ শতাংশ শুল্ক থেকে নেমে আসতে পারে ২০ শতাংশে। এই সাশ্রয় বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য বিশাল একটি প্রণোদনা।

দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিতে বেশ ফারাক রয়েছে। রপ্তানি অনেক বেশি হলেও আমদানিতে ঘাটতি রয়েছে। তুলার মতো একটি বড় কাঁচামাল দেশটি থেকে আমদানি করলে সেই ঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে। এতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

তৃতীয়ত, মার্কিন তুলা দামের দিক থেকে তুলনামূলক একটু ব্যয়বহুল হলেও এর গুণমান বিশ্বসেরা। বিশেষ করে উচ্চমানের ব্র্যান্ড ও বাজারমুখী পোশাক উৎপাদনে মার্কিন তুলার কদর বেশি। ফলে অনেক রপ্তানিকারক তাদের ক্রেতার চাহিদা মেটাতে মার্কিন তুলা ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন।

চতুর্থত, প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা হ্রাস। অতীতে মার্কিন তুলা আমদানির ক্ষেত্রে ডাবল ফিউমিগেশনের মতো ঝামেলাপূর্ণ শর্ত ছিল, যা সময় ও খরচ বাড়িয়ে দিত। সম্প্রতি এই শর্ত বাতিল হওয়ায় আমদানির প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। একই সঙ্গে বন্ডেড গুদাম চালুর উদ্যোগ খরচ আরও কমাবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, পাঁচ বছরে (২০২০-২০২৪) বাংলাদেশ ৩৬টি দেশ থেকে ৩৯ দশমিক ৬১ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করেছে, যার ব্যয় প্রায় ২০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঁচ বছরে ২.৮৪ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১.৮৭ বিলিয়ন ডলার। বছরভিত্তিক তথ্যে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৮ মিলিয়ন বেলস তুলা আমদানি করে। এর মধ্যে মার্কিন তুলার শেয়ার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট আমদানির পরিমাণ একই পর্যায়ে থাকলেও মার্কিন তুলার অংশ কমে ৯ শতাংশে নেমে আসে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈশ্বিক মন্দা ও উচ্চ দামের কারণে আমদানি কিছুটা কমলেও, ব্রাজিল ও আফ্রিকার অংশ বেড়ে যায়। সেখানে মার্কিন তুলা আমদানি আবারও ৯ শতাংশে নেমে আসে।

আমদানি করা তুলার প্রায় পুরোটাই সুতা উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ হাজার ৮৪৯টি স্পিনিং মিল রয়েছে। এ মিলগুলো বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের সুতা উৎপাদন করে, যার বড় অংশ পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত হয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সুতা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে দ্রুত অর্ডার সরবরাহ করতে সাহায্য করে। ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

মার্কিন তুলা আমদানির প্রবণতা বাড়লেও কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জও রয়েছে। মার্কিন তুলা অন্যান্য উৎসের তুলনায় কিছুটা ব্যয়বহুল। পোশাক রপ্তানিতে লাভের মার্জিন যেখানে খুবই সীমিত, সেখানে ব্যয় বৃদ্ধি রপ্তানিকারকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আফ্রিকা বা ভারত থেকে তুলা আনতে সময় কম লাগে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে সময় ও খরচও বাড়ে। সব ক্রেতা উচ্চমানের মার্কিন তুলা চায় না। সস্তা পোশাকের জন্য আফ্রিকা বা ভারতের তুলাই যথেষ্ট। ফলে বাজারভেদে আমাদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি।

বাংলাদেশকে এই ভূ-রাজনীতির জটিল সমীকরণে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়িয়ে ট্যারিফ সুবিধা নিতে হবে, অন্যদিকে বিকল্প উৎস যেমন ব্রাজিল ও আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখতে হবে। এতে সরবরাহ শৃঙ্খল নিরাপদ থাকবে। আর সরকারকে অবশ্যই নীতি সহায়তা দিতে হবে—শিপিং খরচ কমানো, বন্দরে আমদানির সময় হ্রাস করা এবং কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে অযথা প্রশাসনিক জটিলতা দূর করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সুতা শিল্পে প্রযুক্তি বিনিয়োগ ও দক্ষতা বাড়ানোও জরুরি।

আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে আছে সস্তা শ্রমশক্তি ও দক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে। কিন্তু এই শক্তি ধরে রাখতে হলে কাঁচামাল আমদানির কৌশলও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন তুলা আমদানির প্রবণতা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি করছে। যেখানে ট্যারিফ সুবিধা, গুণমান নিশ্চয়তা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে শুধু এক উৎসের ওপর নির্ভর করলে ঝুঁকি বাড়বে। আমাদের প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি। যেখানে মার্কিন তুলার পাশাপাশি আফ্রিকা, ব্রাজিল ও ভারত থেকেও পর্যাপ্ত আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি সহায়তা পেলে তুলার ভূ-রাজনীতি বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবেও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।

লেখক: সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সাকিবকে টপকে রেকর্ড গড়ার দ্বারপ্রান্তে মুস্তাফিজ

সাকিবকে টপকে রেকর্ড গড়ার দ্বারপ্রান্তে মুস্তাফিজ

কারা দিচ্ছে, কারা দিচ্ছে না, কেন তা গুরুত্বপূর্ণ

ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কারা দিচ্ছে, কারা দিচ্ছে না, কেন তা গুরুত্বপূর্ণ

বিএনপি কোনো প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়নি: রিজভী

বিএনপি কোনো প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়নি: রিজভী

প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ, ইনফরমেশন লিক হয়

এনসিপির প্রতিক্রিয়া প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ, ইনফরমেশন লিক হয়

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App