×

মুক্তচিন্তা

ভয় ও আতঙ্ক দূর করুন এবং ‘র’ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ুন

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০২:১৫ পিএম

ভয় ও আতঙ্ক দূর করুন এবং ‘র’ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ুন

ভারতীয় গোয়েন্দা ফরেন সংস্থা র এর প্রতীকী ছবি

২০১৮ সালে আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলাম। সেই চিঠিতে দেশের সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে কিছু স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল। কিন্তু তখন কোনো বড় গণমাধ্যম প্রকাশ করার সাহস পায়নি। শেষ পর্যন্ত দৈনিক একটি সংবাদ পত্রিকা সাহসিকতার সঙ্গে ২ জুন ২০১৮-তে লিখাটি প্রকাশ করে।

সেই ঘটনার পর আমি উপলব্ধি করি — বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শত্রু দুর্নীতি নয়, ভয়। আজ, সাত বছর পর, আমি আবার জাতির উদ্দেশ্যে একই কথা বলছি: যদি মনের ভয়কে জয় করা না যায়, জীবনের স্বাধীনতা কখনোই আসবে না। আর যদি জীবনের স্বাধীনতা না আসে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাও অসম্পূর্ণ থাকবে।

প্রশাসনের দুর্নীতি ও জনদুর্ভোগের বাস্তব চিত্র

- সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২৫ জনের নামের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।

- নির্বাচনে ভোটচুরি, টাকা দিয়ে নমিনেশন, ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে।

- চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে; স্বাস্থ্য ও মৌলিক সেবা পুরোপুরি বিপর্যস্ত।

- চাঁদাবাজির কারণে পলাতক নেতাকর্মীরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দল পরিচালনা করছে।

- অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর জুডিশিয়াল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

- রাষ্ট্রপতি নিজেই একজন স্বৈরশাসকের নির্বাচিত সরকার প্রধান।

- আইনের শাসনের অনিয়মের কারণে যারা দেশ ছেড়ে গেছে, তাদের ফেরত আনা এখন কঠিন।

প্রশ্ন জাগে—বিশ্বজুড়ে যখন আইনের এক জাল আছে, ইন্টারপোল নামের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে, তখন গত ৫৪ বছরে তারা কি একজনকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে? না, একটিও না। কেন? কারণ, বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা এতটাই দুর্বল, দলনির্ভর ও দুর্নীতিগ্রস্ত যে বিশ্বের কোনো দেশই আজ বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে চায় না। যখনই কোনো সরকার ক্ষমতা হারায়, তখনই হাজারো মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রশাসনিক নিপীড়নের শিকার হয় পরাজিত পক্ষ।

ফলে সত্য-মিথ্যা, অপরাধ-অভিযোগ—সবই মিশে গেছে এক অনিশ্চিত ধোঁয়াশায়। এই বাস্তবতাই প্রমাণ করে—আমরা জাতি হিসেবে কতটা দুরবস্থার শিকার, আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। আমরা এখন এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার বন্দি, যেখানে অপরাধীরা পালিয়ে যায়, কিন্তু ন্যায়বিচার পালানোর পথ খুঁজে পায় না।

গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা

গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়। এটি হলো বাকস্বাধীনতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং একজন নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন। যখন মতের ভিন্নতা খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সম্মিলিত ঐক্য গড়ে ওঠে, তখনই জাতি স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পায়।

কিন্তু যদি প্রশাসন, রাজনীতিবিদ বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়, তখন গণতন্ত্রই জাতির জন্য হুমকি। সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, প্রশাসন দুর্বল হয়, এবং দেশের কাঠামো অরাজকতায় পড়ে।

সশস্ত্র বাহিনী ও দেশের উন্নয়ন

উন্নয়নশীল দেশের বাজেটের বড় অংশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বরাদ্দ। কিন্তু তারা যদি শুধুমাত্র ব্যারাকে বসে থাকে, সীমিতভাবে সরকারি কাজে সাহায্য করে বা বিদেশি মিশনে যায়, তবে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেশের উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে কাজে লাগানো উচিত।

“র” — দেশের অন্তর্নিহিত হুমকি

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের উন্নয়নের পথে ‘র’-অর্থাৎ ভারতের গুপ্তচর সংস্থা R&AW-এর সক্রিয় উপস্থিতি। তারা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও প্রশাসনে গুপ্ত হস্তক্ষেপ করতে পারে, গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রভাব বিস্তার করে এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকিতে ফেলে।

জাতির চোখকে খোলা দরকার:

- দেশের প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সশস্ত্র বাহিনী, সচিবালয় — সর্বত্র “র”-এর উপস্থিতি উন্নয়নের পথ ব্যাহত করছে।

- এটি শুধু আতঙ্ক এবং ভয় - তৈরি করছে না, বরং জাতির স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতার জন্য সরাসরি হুমকি।

অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও গ্রামীণ সমাজের ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক গভীর বৈষম্যের ফাঁদে আটকে আছে। শহরনির্ভর উন্নয়নের ফলে গ্রামীণ সমাজ অবহেলিত হচ্ছে। এই বাস্তবতা পাল্টাতে হলে স্থানীয় উদ্যোক্তা, কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও সমবায়ভিত্তিক অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে হবে। একটি টেকসই অর্থনীতি তখনই সম্ভব যখন উন্নয়নের কেন্দ্রে থাকবে মানুষ — তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান।

ড. ইউনূসের নীতিগত ভূমিকা ও বর্তমান চ্যালেঞ্জ

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক ব্যবসা ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির পক্ষে কাজ করেছেন। তবে এখন তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ — নীতি ও বাস্তবতার সমন্বয় করা, যাতে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও অর্থনীতি সমানভাবে ন্যায়সঙ্গত হয়। এই সময়ে তাঁর দায়িত্ব শুধু উপদেষ্টা নয়, একজন জাতীয় নৈতিক পথপ্রদর্শকেরও।

জনগণের অংশগ্রহণ ও বিদেশি নীতির স্বচ্ছতা

একটি রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন জনগণ তার নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে। স্থানীয় সরকার, নাগরিক পরিষদ ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে গণতন্ত্রের কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। একই সঙ্গে দেশের পররাষ্ট্রনীতি হতে হবে স্বচ্ছ ও ভারসাম্যপূর্ণ — কোনো দেশ বা সংস্থার প্রভাব যেন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ না করে।

করণীয় পদক্ষেপ

১. রাজনৈতিক ঐক্য: সব রাজনৈতিক দলকে দেশের স্বার্থে একত্রিত হতে হবে।

২. প্রশাসন শক্তিশালীকরণ: গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য ও সতর্ক নেতৃত্ব নিশ্চিত করা, প্রশাসনকে “র”-মুক্ত রাখা।

৩. সশস্ত্র বাহিনী সক্রিয় করা: অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও জনগণের সেবায় সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করা।

৪. জনসচেতনতা: জনগণকে ভয়কে জয় করতে শেখানো এবং “র”-এর প্রভাব শনাক্ত করে প্রতিরোধে সক্রিয় পদক্ষেপ।

৫. স্বচ্ছতা ও হুইসলব্লোয়ার সুরক্ষা: বড় লেনদেন অনলাইনে প্রকাশ এবং সাংবাদিক ও হুইসলব্লোয়ারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

৬. আইনের শাসন ও ফেরত আনা: যারা দেশ ছেড়ে গেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা এবং দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা।

৭. স্বাস্থ্য ও মৌলিক সেবা পুনর্গঠন: স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন করা, যাতে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত না হয়।

৮. অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও বিদেশি প্রভাব নিয়ন্ত্রণ: স্বনির্ভর উৎপাদন ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতি শক্তিশালী করা।

নতুন প্রজন্মের আহ্বান

আজকের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নতুন প্রজন্মের উপর — আপনাদের উপর, যারা এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস রাখেন। থেমে যাবেন না। যতদিন দেশ ভয়, দুর্নীতি ও মিথ্যার জালে বন্দি থাকবে, ততদিন সংগ্রাম শেষ নয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের পৃথিবীকে অসংখ্য শক্তি দিয়ে সাজিয়েছেন। আমরা প্রায়ই শুধু ঝলমলে দিকটাই দেখি, কিন্তু অদেখা ক্ষুদ্র সত্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জাতির মুক্তি। সত্যকে খুঁজে পাওয়া, ক্ষুদ্রকে মূল্যায়ন করা এবং ভয়কে পরাজিত করাই মানবিক স্বাধীনতার মূল মন্ত্র।

- ভয়কে জয় করুন: ভয় না কাটালে স্বাধীনতা অসম্ভব।

- গণতন্ত্র চর্চা করুন: শ্রদ্ধা, যুক্তি ও দায়িত্বশীল নাগরিক কর্তব্যের মাধ্যমে।

- সশস্ত্র বাহিনীকে কাজে লাগান: শুধু ব্যারাকে নয়, দেশের উন্নয়নে।

- দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দূর করুন: যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করুন।

- শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করুন: নাগরিক সচেতনতা ও স্বনির্ভরতা আনতে।

- বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্ত থাকুন: নীতি ও প্রশাসনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখুন।

- আইনের শাসন নিশ্চিত করুন: যারা দেশ ছেড়ে গেছে, তাদের ফেরত আনা ও দায়ীদের বিচার।

- সত্য বলুন, ভয় হারান: কারণ Never too late to change your mind.

বাংলাদেশ এখন এক সংকটময় মোড়ে দাঁড়িয়ে। অল্প কিছু সৎ পদক্ষেপেই জাতির ভবিষ্যৎ বদলে যেতে পারে — কিন্তু শর্ত একটাই: আমাদের সবাইকে ভয় হারাতে হবে। যে জাতি ভয়কে জয় করতে পারে, সে জাতি স্বাধীন হয়। যে জাতি “র”-কে নির্মূল করতে পারে, সে জাতি গড়ে তুলতে পারে সোনার বাংলা।

আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। একত্রে কাজ করে আমরা গড়ে তুলতে পারি সেই সোনার বাংলা, যেখানে মানুষ বাঁচবে ভয়হীন, স্বাধীন ও মর্যাদার সঙ্গে।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

জুলাই যোদ্ধাদের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

জুলাই যোদ্ধাদের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

কী আছে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায়?

কী আছে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায়?

ফিফা থেকে সুখবর পেলেন হামজা-জামালরা

ফিফা থেকে সুখবর পেলেন হামজা-জামালরা

জুলাই সনদের দিকনির্দেশনা বাংলাদেশকে পরিচালনা করবে : আলী রীয়াজ

জুলাই সনদের দিকনির্দেশনা বাংলাদেশকে পরিচালনা করবে : আলী রীয়াজ

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App