×

মুক্তচিন্তা

কপ ৩০

আমাজনের বুকেই বিশ্ব জলবায়ু যুদ্ধের নতুন অধ্যায়

Icon

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২৬ এএম

আমাজনের বুকেই বিশ্ব জলবায়ু যুদ্ধের নতুন অধ্যায়

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। ফাইল ছবি

৩০তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন (কপ ৩০) বিশ্বের বৃহত্তম রেইনফরেস্ট ব্রাজিলের আমাজনের একটি শহর বেলেমে ২০২৫ সালে ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ব্রাজিলের বেলেমে ১০-২১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠান বিশ্ব নেতা, বিজ্ঞানী, বেসরকারি সংস্থা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ দেবে। ব্রাজিলের জলবায়ু, জ্বালানি ও পরিবেশ বিষয়ক সচিব আন্দ্রে কোরিয়া দো লাগো সভাপতি হিসেবে কপ৩০-এর নেতৃত্ব দেবেন।

এটি আমাজন রেইনফরেস্টে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন। ব্রাজিলের এই ছোট শহরে ৫০ হাজার মানুষের জন্য একটি সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত সর্বদাই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল, কিন্তু ব্রাজিল তা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ২১৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার ল্যাটিন আমেরিকার শক্তিশালী দেশ ব্রাজিল বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং তেল ও গ্যাসের অষ্টম বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো আমাজন রেইনফরেস্ট, জলবায়ু সংকটের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে এবং রেকর্ড পরিমাণ খরা, দাবানলের কারণে পশুপালক ও সয়া চাষীরা ক্রমাগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। তবুও আমাজন বিশ্বের ফুসফুস এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি হটস্পট। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে প্যারিস চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এবারের কপ৩০ সম্মেলন ব্রাজিলকে তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। ২০২৫ সালের জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০ যোগদানের ক্ষেত্রে এশীয় অঞ্চলের প্রতিনিধিদের সমাগম কম পরিলক্ষিত হয়েছে। এক্ষেত্রে উচ্চ যাতায়াত ও উচ্চ আবাসন খরচ, হোটেল কক্ষের অভাব এবং কিছু ভূ-রাজনৈতিক প্রতিকূলতা প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত এই কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ও অর্থায়ন প্রশ্নে উন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ছোট দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সম্মেলনের প্রথম দিনেই জাতিসংঘের ২৫ জন বিশেষজ্ঞ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট নিষেধাজ্ঞা এবং জলবায়ু পদক্ষেপে স্বচ্ছতার দাবি জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত স্পষ্ট করেছে যে সব রাষ্ট্রেরই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি প্রতিরোধ ও প্রশমনে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর আগে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সিবিডিআর নীতির ভিত্তিতে সহযোগিতা আবশ্যক।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুক্তি ছিল যে, তাদের দায় শুধুমাত্র প্যারিস চুক্তি বা কিয়োটো প্রোটোকলের মধ্যে সীমিত, কিন্তু তাদের এই যুক্তি আন্তর্জাতিক আদালত প্রত্যাখ্যান করেছে। বরং পরিচ্ছন্ন ও টেকসই পরিবেশকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ১.৫ ডিগ্রি সে. লক্ষ্যকে একটি আইনগত মানদণ্ডে উন্নীত করা হয়েছে। যদিও কিছু বড় দূষণকারী দেশ রায়কে খাটো করার চেষ্টা করছে, তবে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো ঘোষণা করেছে যে তারা এটিকে কপ৩০ আলোচনার কেন্দ্রে রাখবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতাকে "সহায়তা" নয় বরং আইনি বাধ্যবাধকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত দশ বছরে বন্যা, ঝড়, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসসহ জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা দিনে গড়ে ৭০ হাজার মানুষের সমান। জলবায়ু সংকট, যুদ্ধ, নিপীড়ন ও খাদ্য-জল সংকটকে আরো তীব্র করে "ঝুঁকি গুণক" হিসেবে কাজ করছে, যার ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের মোট সংখ্যা ২০২৫ সালের মধ্যে ১১ কোটি ৭০ লক্ষে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালে ব্রাজিলের বন্যায় ৫.৮ লাখ মানুষ, মিয়ানমারে ঘূর্ণিঝড় মোচায় শরণার্থী রোহিঙ্গারা এবং চাদে বন্যায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষ পুনরায় বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা নির্দেশ করছে যে, জলবায়ু দুর্যোগ এখন বারবার স্থানচ্যুতির প্রধান চালক হয়ে উঠছে।

বিশ্বের প্রায় অর্ধেক বাস্তুচ্যুত মানুষ রাজনৈতিকভাবে ভঙ্গুর দেশগুলোতে সংঘাত ও জলবায়ুর প্রভাবে বিপন্ন, যেমন সুদান, সিরিয়া, হাইতি, কঙ্গো, লেবানন, মায়ানমার ও ইয়েমেন উল্লেখযোগ্য। এই দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে নগণ্য অবদান রাখলেও জলবায়ু অর্থায়ন ও অভিযোজন ফান্ড থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

ইউএনএইচসিআর ব্রাজিলে কপ৩০-এ জলবায়ু আলোচকদের এই দ্রুত বাড়তে থাকা জনসংখ্যার দিকে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন- "অর্থায়ন হ্রাসের ফলে শরণার্থী এবং বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে চরম আবহাওয়ার প্রভাব থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে সীমিত হচ্ছে। আমরা যদি স্থিতিশীলতা চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই এমন জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে যেখানে মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ভবিষ্যতে বাস্তুচ্যুতি রোধ করতে, জলবায়ু অর্থায়ন শীঘ্রই প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলোতে পৌঁছাতে হবে।

কপ৩০-কে ঘিরে বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতিতে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। বরাবরের মত এবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে "সবচেয়ে বড় প্রতারণা" হিসেবে আখ্যা দিয়ে সম্মেলনে উপস্থিত না হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তিনি সরাসরি অংশ না নিলেও দূর থেকে চাপ, হুমকি ও বাণিজ্যিক প্রতিশোধের কৌশল ব্যবহার করে বৈশ্বিক জলবায়ু সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারেন। এর উদাহরণ পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিক সমুদ্র সংস্থার বৈঠকে, যেখানে ট্রাম্পের প্রভাবের কারণে কার্বন শুল্ক অনুমোদন এক বছর পিছিয়ে যায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে (দ্বিতীয়বারের জন্য) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেছে। অপরদিকে, চীন সম্মেলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন এসডিসি নিয়ে সমালোচনা থাকলেও, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দ্রুত অগ্রগতির কারণে দেশটি আলোচনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভারত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে এগিয়ে থাকলেও কপ২৯-এ তাদের কঠোর অবস্থানের কারণে এবারের আলোচনায় নতুন মোড় নিতে পারে। অপরদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজস্ব রাজনৈতিক চাপের মুখে নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা শিথিল করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ইউ ও চীনের সমন্বিত নেতৃত্ব কপ৩০-এ কূটনৈতিক সুবিধা তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্লেষকদের মতে, জলবায়ু অর্থায়ন, নির্গমন লক্ষ্যমাত্রা ও ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাই কপ৩০-এর আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু অগ্রগতির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কপ৩০-এর প্রথম দিনেই ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো বিশ্বের "নৈতিক বিবেক" হিসেবে ধনী ও উচ্চ নির্গমনকারী দেশগুলোকে তাদের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা প্যারিস চুক্তির অন্যতম শর্ত। ১.৫° লক্ষ্যমাত্রা ভেঙে যাওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ। তারা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দ্রুত সরে আসা ও দুর্বল এসডিসি শক্তিশালী করার স্পষ্ট অগ্রগতি চাইবে বলে আশা করা যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় বাধা অর্থায়ন ও অংশগ্রহণের খরচ। তারা দারিদ্র্য মোকাবিলা ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির জন্য বাস্তবসম্মত জলবায়ু অর্থায়ন, ঋণ ছাড় এবং "ঋণ-বিনিময়ে জলবায়ু কর্ম" কাঠামোতে জোর দিচ্ছে। কপ৩০-এর "বাকু-টু-বেলেম" রোডম্যাপ এই দাবির মূল ভিত্তি। পাপুয়া নিউ গিনির প্রধানমন্ত্রী মারাপে পূর্বে কপ-কে "আলোচনা বেশি, কাজ কম" বলে সমালোচনা করে অনুপস্থিত ছিলেন, কিন্তু এবার উন্নত দেশগুলোর প্রণোদনামূলক প্রতিশ্রুতি দেখে উপস্থিত হবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। তিনি বলছেন, তার দেশ একই সঙ্গে জলবায়ু ক্ষতির শিকার ও সমাধান প্রদানকারী, এবং কপ৩০-এ তারা প্রকৃতি সংরক্ষণে ন্যায্য সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানাবে।

ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিতব্য ৩০তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন শুধু একটি বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনার স্থান নয়, বরং এটি বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও মানবিক সংকট তুলে ধরার সবচেয়ে বড় জায়গা। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেইনফরেস্টের কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন প্রমাণ করছে যে জলবায়ু সমস্যা আর কেবল বিজ্ঞানের বিষয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও বেঁচে থাকার লড়াই। ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে আস্থা সংকট, জলবায়ু অর্থায়নের অস্পষ্টতা, এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি দেখিয়ে দিচ্ছে যে হাতে আর সময় নেই। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়, ১.৫° লক্ষ্যকে আইনি মানদণ্ডে উন্নীত করা, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে যাওয়ার দাবি এবং "বাকু-টু-বেলেম" রোডম্যাপ-সব মিলিয়ে কপ৩০ এমন এক সন্ধিক্ষণ, যা হয় টেকসই ভবিষ্যতের দিকে পথ দেখাবে, নতুবা জলবায়ু প্রতিশ্রুতির ইতিহাসে আরেকটি ব্যর্থ অধ্যায় যোগ করবে।

লেখক:

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার,

ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দুষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের রায় যেদিন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের রায় যেদিন

ময়মনসিংহে বাসে আগুন, দগ্ধ হয়ে চালকের মৃত্যু

ময়মনসিংহে বাসে আগুন, দগ্ধ হয়ে চালকের মৃত্যু

ট্রাইব্যুনালে ১১তম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ আজ

আবু সাঈদ হত্যা ট্রাইব্যুনালে ১১তম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ আজ

আমাজনের বুকেই বিশ্ব জলবায়ু যুদ্ধের নতুন অধ্যায়

কপ ৩০ আমাজনের বুকেই বিশ্ব জলবায়ু যুদ্ধের নতুন অধ্যায়

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App