দুই তরুণের সুখের খামার: বদলে যাচ্ছে একটি গ্রাম
গাজী মুনছুর আজিজ, কাহালু (বগুড়া) থেকে ফিরে
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৩ পিএম
দুই তরুণের সুখের খামার
গরু রাখার ঘরকে সাধারণত গোয়ালঘর বলে। তবে বগুড়ার কাহালুর বাঁকাদিঘী পাড়ে সুখের খামারে গরু রাখার ঘরের নাম ‘কাউ স্টুডিও’। এ স্টুডিওতে আছে নানা প্রজাতির ছোট-বড় গরু। পাশেই খোলা চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা প্রজাতির ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গারল, ডরপার বা আফ্রিকান প্রজাতির ভেড়া। চত্বরের পাশে আরও আছে মুরগি, ছাগল ও গরুর আরও কয়েকটি ঘর এবং মাটিছাড়া ঘাস উৎপাদন কেন্দ্র।
খামারটির দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা জোবায়ের ইসলাম এবং তাসদীখ হাবীব। গোয়ালঘর কেনো ‘কাউ স্টুডিও’ হলো সেই খোঁজে অগ্রহায়ণের এক দুপুরে হাজির হই স্বপ্নবাজ দুই তরুণের এ সুখের খামারে। দুই বিঘার এ লাইভ স্টক সেকশনে বর্তমানে ৫০টি গরু, শতাধিক ছাগল-ভেড়া রয়েছে। খামারের আওতায় আরও আছে ১২ বিঘার ধানক্ষেত, দুই বিঘার পুকুর, ১ বিঘার কলার বাগান এবং আধা বিঘায় গড়ে তোলা এগ্রো রিসোর্ট। এসব লালন-পালনে কাজ করছেন ১৯ জন।
জোবায়ের বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সুখের খামারের শুরু ২০২০ সালে। তবে ২০১৬ সাল থেকে অল্প অল্প করে কাজ করি। মূলত খামারি হওয়ার স্বপ্ন অনেক আগে থেকেই। ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে বিবিএ এবং এমবিএ শেষ করে ব্যবসা শুরু করি। আস্থার বাজার নামে একটি অনলাইন শপও খুলি; যেখানে অর্গানিক ও নিরাপদ খাদ্য বিক্রি করি। কিন্তু একটা পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্যের অভাবে শপটি বন্ধ করে দিই। এরই মধ্যে করোনা শুরু হয়। আমিও পরিবার নিয়ে চলে আসি বগুড়ায় এবং খামারের কার্যক্রম শুরু করি।
জোবায়ের বলেন, ঢাকা থেকে একজন শিক্ষিত তরুণ গ্রামে এসে খামার করছেন, এটা দেখে এলাকার লোকজন একটু অবাক হন। পেছনে পেছনে অনেকে কানাঘুষাও করেন। তবে আমি সেসবে কান দিইনি। এ ছাড়া শুরুতে প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হই। বিশেষ করে গরু-ছাগল কেনাবেচা করতে গিয়ে। অনেক সময় লোকসানও হয়েছে, তবু হাল ছাড়িনি।
খামার চত্বর ঘুরে অটো রিকশায় রওনা হই সুখের খামারের ধানক্ষেত দেখতে। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দিয়ে এগিয়ে চলি। পথের দুইপাশে শুধুই ধানক্ষেত। কোনো কোনো ক্ষেতে কৃষক ধান কাটছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত থেকে কৃষক কাটা ধান নিয়ে বাসায় ফিরছেন। পথের পাশে কোথাও দেখা গেল কৃষক মেশিনে ধান সংগ্রহ করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ধানক্ষেতে আসি। ক্ষেতের পাশে বাঁশের মাচা পাতা। এ মাচায় কিছুক্ষণ বসি।
মাচায় বসে গল্প করতে করতে জোবায়ের জানান, সুখের খামারের পাশাপাশি তারা ‘সুখের খামার এগ্রো ভিলেজ’ নামে একটি প্রকল্প দাঁড় করাচ্ছেন। ৩০ বিঘা জমির উপর হবে এ প্রকল্প। এরই মধ্যে জমি কেনার কাজ শেষ। তবে এ প্রকল্প তারা একা একা করবেন না, সঙ্গে নিবেন আরও অনেক শেয়ার হোল্ডার বা পার্টনারস। প্রকল্পে থাকছে সমন্বিত কৃষি খামার, এগ্রো রিসোর্ট, প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ফাউন্ডেশন, মসজিদ এবং হাফেজি এতিমখানা মাদ্রাসা। প্রকল্পের কাজ এরইমধ্যে শুরু হয়েছে, ২০২৭ সালের শেষে কাজ সম্পন্ন হবে।
দুই প্রতিষ্ঠাতা জানান, প্রকল্পের যুক্ত হওয়া পার্টনাররা পাবেন এগ্রো ভিলেজের জমিসহ মালিকানা, ভিলেজ থেকে আয়ের মুনাফা, বছরে একবার পরিবারসহ তিনদিন বিনামূল্যে এগ্রো রিসোর্টে অবকাশ যাপন, উৎপাদিত কৃষিপণ্য স্বল্পমূল্যে কেনার সুযোগ এবং মসজিদ, মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যপদ এবং ফাউন্ডেশনের আজীবন দাতা সদস্য পদ। চাইলে কেউ নিজের মালিকানা হস্তান্তরও করতে পারবেন।
ধানক্ষেত দেখে আসি সুখের খামার রিসোর্টে। মাটির তৈরি ঘর। সাজসজ্জায় নান্দনিক ও আধুনিক। খাবার খেতে খেতে জোবায়ের বলেন, কৃষিক্ষেত্রে শিক্ষিত ও তরুণ লোকের অভাব। আমরা চাই এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত তরুণরা এগিয়ে আসুক। এতে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য ‘ফার্মিং টু ডাইনিং’। অর্থাৎ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ। অন্যদিকে প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয়দের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নও আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। এরইমধ্যে সে ফল সুফল স্থানীয় গ্রামবাসী পেতে শুরু করেছেন।
