×

মুক্তচিন্তা

চট্টগ্রাম থেকে নহাটা বাজার

সিন্ডিকেট, শোষণ এবং আসন্ন নির্বাচনের সামনে নাগরিকের প্রশ্ন

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:২৪ পিএম

সিন্ডিকেট, শোষণ এবং আসন্ন নির্বাচনের সামনে নাগরিকের প্রশ্ন

ছবি: জেমিনি

বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ যে গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার সবচেয়ে বড় কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা নয়। প্রকৃত সমস্যা হলো দেশের প্রতিটি স্তরে, বন্দর থেকে গ্রামাঞ্চলের হাট বাজার পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা সিন্ডিকেট, যোগসাজশ ও সংগঠিত লুটপাট। এই লুটপাটের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ক্ষমতার রাজনীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন এবং দায়িত্বহীন দলীয় কর্মচারীরা।

এই সিন্ডিকেট শুধু আমদানি রপ্তানির নিয়ন্ত্রণই করে না, বরং দেশের গরিব মানুষের মুখের অন্নও ছিনিয়ে নেয়। দেশের নির্বাচনের আগে এই পুরো সত্য জনগণের সামনে তুলে ধরা জরুরি। কারণ জনগণ যদি ক্ষমতার মালিক হয়, তাহলে তারা জানার অধিকার রাখে যে কারা তাদের অধিকার রক্ষা করবে, আর কারা তাদের রক্ত চুষে রাজনীতি করবে।

চট্টগ্রাম বন্দর: সিন্ডিকেটের সুসংগঠিত প্রভাব

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বাণিজ্যের হৃদপিণ্ড। সেখানে যে দুর্নীতি ও ক্ষমতাদ্বেষী সিন্ডিকেট বহু বছর ধরে কাজ করছে, তা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, পুরো দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করে।

  •    শিপ হ্যান্ডলিং অপারেশন, কনটেইনার মুভমেন্ট, কাস্টমস ছাড় প্রক্রিয়া, ফরওয়ার্ডিং কাজ সবখানেই দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটের দখল।

  •    নিয়ম বহির্ভূত লাইসেন্স, টেন্ডার ছাড়া উপকারভোগী নিয়োগ এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এই বন্দরের কাঠামোকে অকার্যকর করেছে।

  •    অনেক প্রতিষ্ঠানকে বছরের পর বছর চুক্তি নবায়ন ছাড়াই কাজ করতে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে।

  •    এসব সিন্ডিকেট আমদানিকারক, রপ্তানিকারক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত সবাইকে অতিরিক্ত ব্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

চট্টগ্রাম বন্দরের এই নোংরা বাস্তবতা একটি বড় প্রশ্ন তুলে দেয়: যেখানে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবেশদ্বার এই অবস্থায়, সেখানে দেশের অন্য অঞ্চলের অবস্থা কতটা ভয়াবহ হতে পারে?

জেলা উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়: ইজারা, দরপত্র এবং সিন্ডিকেটের শেকড়

বন্দরের মতোই জেলার হাট বাজার, উপজেলার ইজারা প্রক্রিয়া, ডিলারশিপ বরাদ্দ এবং খাস জমির নিয়ন্ত্রণে একই ধরনের সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়।

  •    দরপত্র বিক্রি, ডামি দরদাতা ব্যবহার, পূর্বনির্ধারিত ক্রেতা তৈরি, কম মূল্যে ইজারা নেওয়া এবং পরে বহুগুণ দামে বিক্রি করা এখন একটি খোলা সত্য।

  •    রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং প্রশাসনের একটি অংশ মিলে তৈরি করে এক অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী শোষণ নেটওয়ার্ক।

  •    যে কেউ ইজারা নিক বা বাজার পরিচালনা করুক, বছর শেষে লাভের হিসাবে সবসময় সাধারণ কৃষক ও দিনমজুরদের ঘাড়েই চাপ পড়ে।

এই অবস্থা শুধু একটি এলাকা বা একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ক্ষমতায় যেই থাকুক, প্রভাবশালী মহল একই পদ্ধতিতে লুটপাট চালিয়ে যায়।

মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা বাজার: গ্রামের বাস্তব সত্য

নহাটা বাজারের ঘটনা পুরো বাংলাদেশের অপ্রকাশিত বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে। এই ঘটনা বলে দেয় সিন্ডিকেট কিভাবে গ্রামের কৃষক, হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা এবং মেহনতি মানুষের জীবন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।

কী ঘটেছে নহাটা বাজারে

  •    উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নির্ধারিত ইজারা একটি সিন্ডিকেট খুব সামান্য টাকা দিয়ে নিজেদের নামে নিয়ে নেয়।

  •    পরে তারা সেটি ১০ থেকে ১৫ গুণ মূল্যে পুনরায় বিক্রি করে দেয়। উদাহরণ: ৩ লক্ষ টাকায় নেওয়া ইজারা ৩৩ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

  •    যারা পরে বাজারটি চালায়, তাদের আবার ২০ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হয়, কারণ আগের মালিক যে অস্বাভাবিক দামে বিক্রি করেছে, সেই ক্ষতি পুষিয়ে তুলতে হবে।

  •    এই অতিরিক্ত আয় সাধারণ কৃষক, সবজিওয়ালা, ফলচাষী, দিনমজুর এবং খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে আসে।

কিভাবে লুটপাট করা হয়

  •    অতিরিক্ত স্থানভাড়া

  •    বেআইনি বাজার ফি

  •    জোর করে খাজনা আদায়

  •    সাপ্তাহিক হাটের ভেতরে পণ্য বিক্রির বিনিময়ে কমিশন দাবি

  •    স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টি

এই পুরো লুটপাটের মাধ্যমে একদিকে সিন্ডিকেট রাতারাতি ধনী হয়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ আরও দরিদ্র হয়। এভাবে গঠিত প্রতিটি সিন্ডিকেট ক্ষমতা পেলে আরও শক্তিশালী হয়, আর ক্ষমতা হারালে প্রশাসনকে টাকা দিয়ে আবার সিন্ডিকেট তৈরি করে নেয়।

এটাই বাংলাদেশে সিন্ডিকেট রাজনীতির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ।

মূল প্রশ্ন: জনগণ যদি মালিক হয়, তাহলে দেশের অবস্থা এমন কেন?

গণতন্ত্রে বলা হয়, জনগণ ক্ষমতার মালিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো যারা ক্ষমতায় আসে তারা কি সত্যিই জনগণের জন্য কাজ করে, নাকি প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিজেদের পকেট ভরার জন্য কাজ করে?

যদি ক্ষমতায় আসার আগেই তারা হাট বাজার সিন্ডিকেট, ইজারা বাণিজ্য, বন্দর লুটপাট, ডিলারশিপ কারসাজি এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের মতো কাজ করে থাকে, তাহলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা কী করবে?

এই ইস্যু নির্বাচনের আগে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে আসা উচিত

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা বাজার পর্যন্ত একই সুতোর মালা। এটি শুধু দুর্নীতি নয়; এটি একটি সিস্টেমিক অর্থনৈতিক শোষণ কাঠামো।

নির্বাচনের আগে জনগণের সামনে সত্য স্পষ্ট হওয়া জরুরি:

রাজনৈতিক দলগুলো কি সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবা করতে চায়, নাকি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিজেদের লোকদের ধনী করতে চায়?

জনগণ কি ভোট দেবে সেইসব দলকে যারা ক্ষমতায় আসার আগেই রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করে?

প্রশাসনের কাছ থেকে জনগণ কিভাবে নিরাপত্তা, ন্যায় এবং সুরক্ষা আশা করবে, যখন প্রশাসনের একটি অংশই সিন্ডিকেটের অংশীদার?

আজ এই প্রশ্নের উত্তর না চাইলে আগামী দশ বছরও একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি দেখব।

রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

ছাত্রশক্তির নেত্রীকে বিয়ে করলেন এনসিপির হান্নান মাসউদ

ছাত্রশক্তির নেত্রীকে বিয়ে করলেন এনসিপির হান্নান মাসউদ

সিন্ডিকেট, শোষণ এবং আসন্ন নির্বাচনের সামনে নাগরিকের প্রশ্ন

চট্টগ্রাম থেকে নহাটা বাজার সিন্ডিকেট, শোষণ এবং আসন্ন নির্বাচনের সামনে নাগরিকের প্রশ্ন

দৃষ্টি হারিয়েও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের আলো ফিরিয়ে দিচ্ছেন সাইদুল হক

দৃষ্টি হারিয়েও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের আলো ফিরিয়ে দিচ্ছেন সাইদুল হক

শহীদ জিয়া আরাফাতের ময়দানে নিম গাছ লাগিয়ে দেশের সুনাম বাড়িয়েছেন

শহীদ জিয়া আরাফাতের ময়দানে নিম গাছ লাগিয়ে দেশের সুনাম বাড়িয়েছেন

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App