অভয়নগরের জনপদে এখনও পোড়াচিহ্ন, আতঙ্ক কাটেনি আক্রান্তদের

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য, অভয়নগর (যশোর) থেকে ফিরে
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৮ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
বাড়ির উঠোনের এক কোনে পোড়া বালিশ আর তোষক বৃষ্টিতে ভিজছে। তার একটু দূরে পোড়া দুটো মোটরসাইকেল। পাশেই পানি সেচের শ্যালো মেশিন পুড়ে ছাই হয়ে আছে। এসব দেখতে দেখতে ঘরের দেয়ালে চোখ যেতেই সেখানে আগুনে পুড়ে যাওয়ার কালো দাগ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। পুড়ে যাওয়া টিন বদলে দিয়ে সেনাবাহিনী নতুন টিন লাগিয়ে দিচ্ছে। তবু বাড়ির মালিকের চোখে নিরাশা। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে চোখ যেন গর্তে বসে গেছে। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যেন পথে বসে গেছেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহরমসিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদা পাড়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের পান্না বিশ্বাস। গত ২২ মে ওই গ্রামের ২০টি সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ও ভাঙচুর, লুটপাট করা হয়েছে। তাতে পান্না বিশ্বাসের বাড়িও পুড়েছিল, লুটপাটও হয়েছে।
প্রায় এক মাস দশদিন আগে পুড়ে যাওয়া ওই জনপদের বাসিন্দাদের গত বুধবার দেখে আসে ভোরের কাগজ। ওই সময় ভোরের কাগজের প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নিজের সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা জানান পান্না বিশ্বাস। কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে এই প্রতিবেদককে টেনে নিয়ে গোয়ালঘরে যান। সেখানে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে পান্না বিশ্বাস বলেন, ঘর পুড়েছে, জমানো সম্পদ পুড়েছে, নগদ ৬০ হাজার টাকাও পড়েছে, এর সঙ্গে পুড়েছে স্বপ্নও। কিভাবে পুড়ল ‘স্বপ্ন’ জানতে চাইলে পান্না বিশ্বাস বলেন, আমার ৬টি গরু ছিল। সেদিনের আগুনে ৬টি গরু আগুনের লেলিহান শিকার উত্থাপ গায়ে মাখছিল। এতে দুটি গরু সেদিনই মারা গেছে। তাতে প্রায় দেড় লাখ টাকা ক্ষতি হয়ে।
বাকি চারটি গরুর মধ্যে দুটি গরু আগুনের উত্তাপে দিন দিন ঝিমুতে থাকে। একপর্যায়ে গত সপ্তাহে অত্যন্ত কম টাকায় দুটো গরু বেচে দেই। বাকি দুটো গরু রয়েছে। গরুগুলোকে বড় করে বিক্রি করে বেশি টাকা জমিয়ে মেয়ের বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু সে স্বপ্ন তো পুড়ে গেল। এখন খাওয়া-দাওয়া কিভাবে করেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঘরই ঠিক হয়নি, আবার খাওয়া-দাওয়া। ঘর মেরামতের কাজতো চলছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পুড়ে যাওয়া ঘরের চাল, দেয়াল ও মেঝে মেরামত করে দিচ্ছে। কিন্তু সব যে শুন্য হয়ে গেল। এই শুন্য মেরামত হবে কী করে?
যশোরের অভয়রনগর উপজেলার ডহরমসিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদা পাড়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের পাড়া ঘুরে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া ২০টি বাড়িতেই একই পোড়াচিহ্ন বহন করছে। ঘরের জিনিসপত্র সব ভেঙ্গে তছনছ। লুটপাটের ফলে সব ঘর শুন্য হয়ে পড়ছে। প্রত্যেকটি বাড়ির উঠানে তাবু টানিয়ে তারা রাত পার করছেন। রীতা বিশ্বাসের বাড়িতে শ্রমিকরা মেঝে পাকাকরণের কাজ করছেন। পোড়াবাড়ি মেরামতের কাজ কি নিজেই করাচ্ছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আর্মি (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) পোড়া বাড়িগুলো মেরামত করে দিচ্ছে। আগুন লাগার পর কিছুদিন কারেন্ট ছিল না। এখন কারেন্ট এসেছে।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, কিছুদিন আগে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আগুনে ছেলের বিয়ের সবকিছু পুড়ে গেছে। পাশে দাঁড়ানো আশলতা বিশ্বাস বলেন, যখন আগুনে দিচ্ছে আমরা তখন পাশের বাড়িতে একটি উৎসবে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে আমার ভয়ে পার্শ্ববর্তী বিলে গিয়ে আশ্রয় নেই। বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছি, একটু একটু করে তৈরি হওয়া আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এরপরে আর্মির সাহায্য, মানুষের সাহায্যের কারণে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। মনে হচ্ছে-আমাদের সব আছে। কিন্তু সেই স্বপ্নতো আর ফিরবে না, পুড়ে গেছে।
সবিতা বিশ্বাস নামের আরেকজন জানান, যারা আমাদের বাড়ি পুড়াইল তাদের ধরল না পুলিশ। উল্টো আমাদেরই পাশের বাড়ির সুজিত বিশ্বাসের ছেলে সাগর বিশ্বাসকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। নিহত কৃষকদল নেতা তরিকুল ইসলামের হত্যা মামলায় নার্সিং কোর্সে অধ্যয়নরত সাগর বিশ্বাসকে পুলিশ আটক করে। আজো তার জামিন মেলেনি। এসময় পাশে দাঁড়ানো সঞ্চিতা মন্ডল বলেন, আগুন লাগার পরে পুলিশ এসে আমাদের পাড়ার পুরুষ লোকদের খূঁজতে থাকে। ভয়ে সব পুরুষ লোক পালিয়ে যায়। সাগর পালাতে পারেনি। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এসময় কল্পনা বিশ্বাস নিজেই নিজেকে বলতে থাকেন, ‘সব পুড়ি গেছি, আর কথা বলতি থাকলি নাব হবিনি, সব শেষ হয়ি গেল’?
সবমিলিয়ে মাসাধিকাল গেলেও হামলার ঘটনার ওই সম্প্রদায়ের মানুষরা এখনো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, রাতে নিজের বাড়িতে থাকছেন না তারা। আশেপাশের গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে রাতে থাকছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূলত মাছের ঘেরের ব্যবসা নিয়ে এমন আক্রমণ। গত ৫ আগস্টের পর মাছের ঘের নিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নানা ধরণের আক্রমণ হতে থাকে। একপর্যায়ে আগুনে বাড়িঘর পুড়ে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুব সংগঠন যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি শিমুল সাহা যশোরের অভয়নগরের ওই আক্রান্ত এলাকা দু’বার পরিদর্শন করেছেন। কেন হামলা হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলত মাছের ঘেরের ব্যবসার দ্বন্দ্ব থেকেই এমন হামলা। তার মতে, মাছের ঘেরের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থানীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে ভয়ভীতি ধরিয়ে তাড়িয়ে দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। অন্যান্য জায়গার মত এখানেও পরিকল্পিতভাবে হামলা করে হিন্দু শুন্য করতে পারলেই পুরোটা তাদের নিয়ন্ত্রণে যাবে-এমন ধারণা থেকে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়েদা পাড়ার যে বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেই বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া অন্য বাড়িগুলো থেকে বেশ কিছুটা দূরে হলেও পরে সেসব বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। গত ২২ মে সন্ধ্যায় যে সময়ে পৌর কৃষক দল সভাপতি তরিকুল সরদার নিহত হন সে সময় পার্শ্ববর্তী বাড়িতে চলছিলো মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বাৎসরিক যজ্ঞ উৎসব। তিন দিনব্যাপী এই উৎসব ২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত চলার কথা ছিল। যজ্ঞ উপলক্ষ্যে পাঁচ থেকে ছয়শো মানুষের খাবারেরও আয়োজন করা হয়েছিল সেদিন।
ওই গ্রামেরই বাসিন্দা দিলীপ বিশ্বাসের বাড়িও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, করা হয়েছে লুটপাট ও ভাংচুর। এক লাখ টাকার উপরে ক্যাশ নিয়েছে, সোনার চেইন নিয়েছে একটা। টিভি, ফ্রিজ ভাংচুর করেছে। এগুলো একদম অকেজো হয়ে গেছে। আলমারি, ড্রেসিং টেবিলও ভাংচুর করেছে। সবমিলিয়ে গ্রামের মোট ২০ টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সেদিন আনুমানিক সন্ধ্যা ছয়টা দশ মিনিটের দিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং পরে পৌনে সাতটায় আগুন দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বললেও স্থানীয় প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস রাত এগারটার পর উপস্থিত হয়েছিল। আসতে পারেনি নাকি আসেনি এটা তাদের ব্যাপার। চার ঘণ্টা ধরে তারা লুটপাট, অগ্নি সংযোগ করেই গেছে।
ওই দিন যজ্ঞের কারণে মাইকের শব্দ এবং ঢাকের আওয়াজের কারণে প্রথমদিকে কেউ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বুঝতে পারেনি বলে জানান তিনি। পরে যখন ওই পাড়া থেকে দুই-একজন মহিলা দৌঁড়ে আসে তখন সবাই হত্যার কথা জানতে পারে। কিন্তু এরই মধ্যে শত শত মানুষ গ্রামে হামলা চালাতে শুরু করে। তবে প্রথমে গ্রামবাসী নিজেদের বাড়িতে থাকলেও আগুন দেয়া শুরু হলে জীবন বাঁচাতে বিলের আশেপাশের মাঠে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তিনি বলেন, পাঁচ-ছয়শো লোকের জন্য রান্না চলছিল। প্রথম হামলা ওরা ওইখানে চালায়। রান্নার কড়াই টড়াই সব উল্টে ফেলে দেয়। মহিলা থেকে শুরু করে বয়স্ক লোক সবাইকে মারধর শুরু করে। পরে হামলাকারীরা নিকটস্থ সুন্দলী বাজারের কয়েকটি দোকান লুটপাট ও ভাঙচুর করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ওই গ্রামেরই আরেকজন বাসিন্দা হাটগাছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিকাশ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়ির তিনটি ঘরও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওই সময় বাড়িতে তার বৃদ্ধা মা উপস্থিত ছিলেন। পাশের গ্রামের একটি বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন, তার বৃদ্ধ মা হামলাকারীদের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতে আগুন না দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু হামলাকারীরা সেসময় তাকেও পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল। আতঙ্কে এখনো বাড়িতে থাকছেন না বলে জানান এই শিক্ষক।
ঘটনার পরে বিভিন্ন সংগঠন এখানে অনুদান দিয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ১৮ জনকে ১৬ পিস টিন, ৩০ কেজি করে চাল এবং ছয় হাজার টাকার চেক দেয়া হয়েছে। এছাড়া দুইটি কম্বলও দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্র হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ক্ষতিগ্রস্থ ২৪টি পরিবারকে ২ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে, যা বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে হিন্দুদের ওপর বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কয়েক মাসে ভারতের সাথে এই ইস্যুতে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশের সরকার বারবারই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। এ অবস্থায় যশোরের অভয়নগরের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলে। সেখানে আগুন লাগার পরের দিনই অর্থাৎ গত ২৩ মে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি’র একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে সাক্ষাৎ করেন।
এসময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের কাছে তারা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান এবং এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ পাশে দাঁড়াতে ও ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য যশোরের অভয়নগর সফর করার কথা জানান। কিন্তু এরপরে মাসাধিকাল পার হলেও তারা এখনো আসেননি। কিন্তু এই ঘটনার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রভাব পড়বে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে যশোর জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি সন্তোষ দেব জানান, এসব ঘটনায় হয়ত একটু কথাবার্তা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ঘটনা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হবে না। আর বাংলাদেশ যুব ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সুদীপ্ত শর্মা বলেন, দুর্যোগের পরে আমরা অভয়নগর গিয়েছি, আরো যাব। এমন দুর্যোগে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সবাই সবার পাশে থাকলে ‘অভয়’ ফিরে পাব।