ভুঁইফোড় কলেজ, প্রতারণায় ভর্তি
কানাইঘাটে ১০০ গজের ভেতরে দুই ভুয়া কলেজ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
নেই কোনো স্থাপনের অনুমোদন, নেই কোনো পাঠদানের অনুমোদন। তবুও চলছে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির বাহারি বিজ্ঞাপন। শুধু বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্ষান্ত নয়, শিক্ষার্থীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চলছে ভর্তির জন্য অভিযান। সংবর্ধনার নামে জোর করে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রাড কার্ড নিয়ে প্রতারণা করে কলেজগুলো নিজেরাই শিক্ষার্থীদের পক্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন করে দিয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো কলেজে আবেদন করতে পারছে না-এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক। এটি শুধু সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার ৩নং দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়নের সড়কের বাজারে দুটি ভুয়া কলেজের সড়কের বাজার ইউনাইটেড কলেজ ও সড়কের বাজার মহিলা কলেজের চিত্র নয়। সারাদেশে এমন অন্তত শতাধিক ভুঁইফোড় কলেজ রয়েছে, যাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোনো অনুমতিই নেই। এখন প্রতারণা করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সারাদেশে এমন ভুয়া কলেজের পরিসংখ্যান কোনো শিক্ষা বোর্ডই বের করতে পারেনি। যখন শিক্ষার্থীরা এসব কলেজে ভর্তির আবেদন করে বিপদে পড়ে তখনই এসব অপকর্ম বেরিয়ে আসে। তারপরে শুরু হয় তদন্ত। কিন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জানতে চাইলে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, এখন অনলাইনে একাদশ শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ভুয়া কলেজগুলো কোনোভাবেই শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে না। আমরা শিগগিরই কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় ১০০ গজের ব্যবধানে বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের রুম ভাড়া করে ভুঁইফোড় কলেজ দুটিতে চলতি শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম চলছে। শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদনহীন গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে মুহাম্মদ বশির আহমদ (যিনি জকিগঞ্জ উপজেলার শাহবাগ স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক) সড়কের বাজার ইউনাইটেড কলেজের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন ব্যতীত সভাপতি হিসেবে মো. জাহাঙ্গীর আলম (যিনি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনার সহকারী পদে কর্মরত) সড়কের বাজার মহিলা কলেজের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন পত্রিকায়। তাদের এই ধরনের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বেআইনি, অবৈধ ও সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ।
নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গত ২৪ জুলাইয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির নীতিমালায় অনুচ্ছেদ ৮ এ পরিষ্কারভাবে বলা আছে, অনুমতি বা স্বীকৃতিবিহীন কলেজ/সমমানের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিষিদ্ধ। স্থাপনের অনুমতি আছে কিন্তু পাঠদানের প্রাথমিক অনুমতি নেই এরূপ কলেজ/সমমানের প্রতিষ্ঠান কোনো অবস্থাতেই ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাতে পারবে না।
এর আগে ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন সংক্রান্ত জারি হওয়া এক পরিপত্রে বলা হয়েছে, কোনো এলাকায় উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হলে প্রথমে স্থাপনের অনুমোদনের জন্য ওই এলাকার জনসংখ্যা ন্যূনতম ৭৫ হাজার এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান থেকে প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব ৪ কি:মি: হতে হবে (দূরত্ব সনদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নির্ধারণ করবেন) এবং স্থাপনের জায়গায় জমির অখন্ডতা, পরিমাণ ও মালিকানা সম্পর্কে সহকারী ভূমি কমিশনার এর প্রত্যয়নপত্রসহ সংশ্লিষ্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড এ আবেদন করতে হবে।
সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর কলেজগুলো ভর্তি এবং পরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। কিন্তু কানাইঘাটের সড়কের বাজার ইউনাইটেড কলেজের অফিসে গেলে দেখা যায়, চেয়ার টেবিল সাজিয়ে ৩/৪ জন কর্মচারী বসে ভর্তির কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক তাদের প্রতিষ্ঠানের স্থাপনের এবং পাঠদানের অনুমোদন আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে জানান, তাদের কোনো অনুমোদন নেই। অন্য কলেজের নামে তারা শিক্ষার্থী ভর্তি করছেন। এভাবে ভর্তি নিষিদ্ধ জেনেও আপনারা ভর্তি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা নিশ্চুপ থাকেন।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে ১০০ গজ দূরে অবস্থিত সড়কের বাজার মহিলা কলেজে উক্ত প্রতিবেদক দেখতে পান, ২/৩ জন লোক ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম নিজেকে অধ্যক্ষ দাবী করে জানান, তাদের কোনো অনুমতি নেই। কিন্ত ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এভাবে অনুমোদনহীনভাবে ভর্তি কার্যক্রম নিষিদ্ধ জেনেও আপনারা কিভাবে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, এই দুটি ভুয়া কলেজের আধা কিলোমিটারের মধ্যে একটি এমপিওভুক্ত কলেজ রয়েছে। উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার সাখাওয়াত হোসেন দুটি ভুয়া কলেজ সম্পর্কে বলেন, এই ২টি কলেজের কর্তৃপক্ষকে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা না করার জন্য মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছি।
সদ্য এসএসসি পাস করেছেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সড়কের বাজার এলাকার নাসরিন জাহান। কলেজে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। ২১ জুলাই ‘সড়কের বাজার মহিলা কলেজ’ নামে সদ্য গজিয়ে উঠা নামে একটি প্রতিষ্ঠান এসএসসি পাস কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে সাবরিনা আক্তার রিমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনুষ্ঠানে তাকে একটি ফরম দেয়া হয় পূরণ করার জন্য। সেদিনই তিনি জানতে পারেন, তার উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির জন্য আবেদন করা হয়ে গেছে। অথচ তিনি নিজে কোনো আবেদন করেননি।
সাবরিনা আক্তার বলেন, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সময় একটি ফরমে নাম, মোবাইল ফোন নম্বর নেয়া হয়েছিল। আমরা ফরম পূরণ করে বাড়িতে চলে যাই। পরে বিকালে কলেজ থেকে মোবাইল ফোনে কল করা বলা হয় রেজিস্ট্রেশন কার্ড, মা-বাবার আইডি কার্ডের ফটোকপি, নিজের দুই কপি ছবি দেয়ার জন্য। পরে আমরা তাদের কাছে কাগজপত্র এনে দিয়েছি, তখনও আমরা পরিবারের কাউকে বলিনি। পরে পরিবারকে জানাই। পরিবার গিয়ে কলেজকে বলে। তখন তারা বলেন, আবেদন করে দিয়েছেন। পরে আমরা ২৯ জুলাই কলেজে এসে বলেছি, এখানে ভর্তি হব না। বাড়িতে গিয়ে আবার তাদের কল করে জানিয়েছি, এখানে ভর্তি হব না। তবুও তারা আমাদের নামে আবেদন করে দিয়েছেন। পরে আমরা কলেজে এসে বলেছি, আমাদের আবেদন কার্ড, পাসওয়ার্ড দেয়ার জন্য। তারা বলছেন, ২০ তারিখের পরে দেবেন। জোর করে আমাদের ভর্তির আবেদন করে নিয়েছেন। এখন তারা বলেন, ভর্তি হলে আমাদের গাইড দেবেন, আরো কতকিছু দেবেন।