জ্বালানি সংকটে নতুন আশা: দেশজুড়ে বাড়ছে সৌর বিদ্যুতের চাহিদা

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:১১ পিএম

জ্বালানি সংকটে নতুন আশা: দেশজুড়ে বাড়ছে সৌর বিদ্যুতের চাহিদা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার: ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির অস্থিতিশীল বাজার এবং পরিবেশ সুরক্ষার তাগিদে বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানা, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষি পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই নবায়নযোগ্য এই জ্বালানির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সরকারের নীতিগত সহায়তা এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এই পরিবর্তনের পালে নতুন হাওয়া দিয়েছে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উৎস হিসেবে সৌরশক্তি বা সোলার পাওয়ার দেশের বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায়, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পথে হাঁটতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একসময় সৌর বিদ্যুৎ কেবল গ্রিডবিহীন এলাকার মানুষের ভরসা হলেও, এখন তা জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠছে।
শিল্প ও কৃষিতে বিপ্লব: শিল্প মালিকদের মতে, বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং উৎপাদন খরচ কমাতে ছাদে সোলার বা সৌর প্যানেল স্থাপন একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। টেক্সটাইল ও পোশাক খাতের অনেক বড় কারখানা ইতিমধ্যে নিজেদের বিদ্যুতের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সৌরশক্তি থেকে পূরণ করছে। এতে তাদের বিদ্যুৎ বিল যেমন কমেছে, তেমনই পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণেও তারা এগিয়ে থাকছে।
নেট মিটারিং সুবিধা: শিল্প-কারখানা ও আবাসিক ভবনের ছাদে সৌর প্যানেল স্থাপনকে উৎসাহিত করার জন্য সরকার ’নেট মিটারিং’ নীতিমালা চালু করেছে। এর আওতায় গ্রাহকরা নিজেদের ব্যবহারের পর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এটি শিল্প খাতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ বিষয়ে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নেট মিটারিং নীতিমালার আওতায় শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ব্যবহারের পর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করতে পারছে। এই সুবিধাটি বেসরকারি খাতকে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। আমরা ইতিমধ্যে কয়েকশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এই খাত থেকে পাচ্ছি।
রহিমআফরোজ ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড (আরডিএল) দীর্ঘদিন ধরে সোলার প্যানেল ও ব্যাটারি ব্যবসায় জড়িত, বর্তমানে তারা লেড এসিড এবং লিথিয়াম ব্যাটারির আইপিএস তৈরি ও বাজারজাত করছে, নতুন এই আইপিএস জাতীয় গ্রিডের পাশাপাশি সৌরশক্তি থেকে চার্জ নেয়, যা বিদ্যুৎ খরচ অনেকাংশে কমিয়ে আনে। নওয়াজ আব্দুর রহিম, হেড অব সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং, আরডিএল বলেছেন: "বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত সমাধান হয়ে উঠছে। শিল্প ইউনিটগুলোতে ছাদে সৌর প্যানেল শুধু বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করছে না, বরং পরিচালনার খরচও কমাচ্ছে, যা তাদের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখছে। ধীরে ধীরে জ্বালানি চালিত জেনারেটরগুলোও সৌরভিত্তিক সমাধানে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। রহিমআফরোজ ইতোমধ্যে বুয়েটের জন্য ১০০ কিলোওয়াট ব্যাটারি ইমার্জেন্সি স্টোরেজ সিস্টেম (বিইএসএস) সিস্টেম স্থাপন করেছে, যা সূর্য থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। আর বাড়ি ও ছোট ব্যবসার জন্য ছোট বিইএসএস ইউনিট চালু করেছে, যা গ্রাহকদের কাছ থেকে ভালো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে।
কৃষিক্ষেত্রেও সৌরশক্তিচালিত সেচ পাম্প কৃষকের খরচ কমাচ্ছে, উৎপাদন বাড়াচ্ছে এবং টেকসই চাষকে সহজ করছে। নেট মিটারিং নীতি এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে, আমি বিশ্বাস করি সৌর বিদ্যুৎ এই খাতে খরচ সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গাইবান্ধার কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, আগে ডিজেল কিনে সেচ দিতে প্রতি মৌসুমে অনেক টাকা খরচ হতো। এখন সোলার পাম্প বসানোর পর সেই খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। দিনের বেলায় সূর্যের আলোতেই সেচের কাজ হয়ে যায়।
সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ও বড় প্রকল্প
সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য পূরণে সৌরশক্তিকেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বড় আকারের সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র বা সোলার পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে।
সোলার পার্ক স্থাপন: সম্প্রতি গাইবান্ধায় ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দেশের বৃহত্তম সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- তিস্তা সোলার লিমিটেড (২০০ মেগাওয়াট), গাইবান্ধা; বর্তমানে দেশের বৃহত্তম সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। ময়মনসিংহ সোলার পাওয়ার (৫০ মেগাওয়াট), ময়মনসিংহ। সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক। কাপ্তাই ৭.৪ মেগাওয়াট ভাসমান সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র।
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস:
দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ আমদানি করা গ্যাস, তেল ও কয়লার ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব জ্বালানির দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। সৌরবিদ্যুৎ এই আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করছে।
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও খরচ হ্রাস:
গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী সৌর প্যানেলের দাম প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ কমেছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে প্যানেলের কার্যক্ষমতাও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণ কমে আসায় সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন এখন অনেক বেশি লাভজনক।
গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন ও সেচ ব্যবস্থা:
সোলার হোম সিস্টেম: যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, সেখানে "সোলার হোম সিস্টেম" বিপ্লব ঘটিয়েছে। প্রায় ৬০ লক্ষেরও বেশি পরিবার এই সুবিধার আওতায় এসেছে, যা বিশ্বের অন্যতম সফল সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি।
সৌর সেচ পাম্প: ডিজেলচালিত সেচ পাম্পের পরিবর্তে সৌরশক্তিচালিত সেচ পাম্পের ব্যবহার বাড়ছে। এতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমছে এবং পরিবেশ দূষণও রোধ হচ্ছে।
পরিবেশগত সচেতনতা:
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সৌরবিদ্যুৎ একটি পরিবেশবান্ধব ও কার্বনমুক্ত জ্বালানি হওয়ায় এর প্রসার বাড়ছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
নওয়াজ আব্দুর রহিম আরও বলেছেন, “বাংলাদেশে সৌর শক্তি গ্রহণে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, বাধ্যতামূলক সৌর ইন্সটলেশনগুলো ঠিকভাবে করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা। আর সাময়িক খরচ কমানোর জন্য নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত সিস্টেমের মান কমাতে পারে। এই প্রক্রিয়াগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো জরুরি, যাতে গ্রাহকের আস্থা থাকে, নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং সৌর শক্তির পুরো সুবিধা নেওয়া যায়।"
সামগ্রিকভাবে, সৌর বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য শুধু বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের একটি পথ নয় বরং এটি একটি টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি।