বাংলাদেশে ছবি নির্মাণ: শিল্প, সংগ্রাম ও সম্ভাবনার সমন্বয়

নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ০৩:২৮ এএম

নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল, চলচ্চিত্র গবেষক, সংস্কৃতি বিশ্লেষকও চলচ্চিত্র পরিচালক
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়- এটি সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি ও ইতিহাসের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এক সময়ের ‘ঢালিউড’ নামটি ছিল এক গর্বের প্রতীক, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। তবে আজকের নির্মাতারা নতুনভাবে ভাবছেন, প্রযুক্তি ও ভাবনার সমন্বয়ে গড়ে তুলতে চাইছেন এক আধুনিক সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। এই লেখায় আমরা দেখব, বাংলাদেশে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পেছনে কীভাবে কাজ করে একটি গোটা সিস্টেম—এর সূচনা, চ্যালেঞ্জ, এবং সম্ভাবনার খতিয়ান।
১. চিত্রনাট্য: ধারণা থেকে কাহিনী
একটি সিনেমার আত্মা তার গল্প। বাংলাদেশে এখন অনেক নির্মাতা সাহিত্য, বাস্তব ঘটনা বা মৌলিক কল্পনার ওপর ভিত্তি করে চিত্রনাট্য তৈরি করছেন। যদিও এক্ষেত্রে পেশাদার স্ক্রিপ্ট রাইটারের অভাব রয়েছে, তবুও ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট হাব।
২. প্রযোজনা: বাজেট বনাম বাস্তবতা
চলচ্চিত্র নির্মাণের সবচেয়ে বড় ধাপ হলো প্রযোজনা। একজন প্রযোজক শুধু অর্থ বিনিয়োগই করেন না, বরং পুরো প্রক্রিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে বেশিরভাগ সিনেমার বাজেট সীমিত, ফলে আন্তর্জাতিক মানের প্রোডাকশন মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, সরকারি অনুদান এবং বিদেশি কো-প্রোডাকশনের সংযুক্তি এই সমস্যার কিছুটা সমাধান করছে।
৩. শিল্পী ও কলাকুশলী নির্বাচন
একটি ভালো সিনেমার জন্য দরকার মেধাবী অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং দক্ষ টেকনিক্যাল টিম। বাংলাদেশে তারকা নির্ভরতা এখনও বিদ্যমান, তবে নতুন মুখদের নিয়েও কাজ হচ্ছে। সিনেমাটোগ্রাফার, এডিটর, প্রোডাকশন ডিজাইনার, সাউন্ড ডিজাইনারদের মূল্যায়নও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।
৪. শুটিং ও লোকেশন
বাংলাদেশের প্রকৃতি ও লোকেশন বৈচিত্র্যে ভরপুর। শহর, গ্রাম, পাহাড়, নদী—সবই আছে এক ছাদের নিচে। কিন্তু শুটিংয়ের সময় অনুমতি, লজিস্টিক সাপোর্ট এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে অনেক বাধা আসে। সঠিক প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট ছাড়া কাজ করা কঠিন।
৫. পোস্ট-প্রোডাকশন: সিনেমার চূড়ান্ত রূপ
এডিটিং, কালার গ্রেডিং, ভিএফএক্স, সাউন্ড ডিজাইন—এসব কিছু মিলিয়ে সিনেমা পায় তার চূড়ান্ত রূপ। আমাদের দেশে অনেকেই এখনও পোস্ট-প্রোডাকশনকে গৌণ মনে করেন, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতার জন্য এটি এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হয়ে উঠেছে।
৬. সেন্সর বোর্ড ও মুক্তি
চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র ছাড়া মুক্তি পায় না। অনেক সময় সেখানে ‘আবেগ-নির্ভর’ সিদ্ধান্ত দেখা যায়, যা নির্মাতাদের সৃজনশীলতা রোধ করে। তারপর রয়েছে প্রেক্ষাগৃহ সংকট—দেশজুড়ে সক্রিয় সিনেমা হলের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কম।
৭. বিপণন ও দর্শকপ্রাপ্তি
একটি ছবি সফল করতে হলে শুধু নির্মাণ নয়, তার বিপণনও জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল প্রচারণা এখন মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণও নতুন জানালা খুলে দিয়েছে।
শেষ কথা
বাংলাদেশে সিনেমা নির্মাণ একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পকর্ম, যার প্রতিটি স্তরেই রয়েছে সংগ্রাম ও সৃজনশীলতা। সময় বদলাচ্ছে, দর্শকের চাহিদা বদলাচ্ছে—এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যারা সাহস করে এগোচ্ছে, তারাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সিনেমাকে নিয়ে যাবে আন্তর্জাতিক উচ্চতায়।
লেখক: নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল, চলচ্চিত্র গবেষক, সংস্কৃতি বিশ্লেষকও চলচ্চিত্র পরিচালক