×

ফ্যাশন

ঢাকাই জামদানি যখন দিল্লি মাতিয়ে তুলেছে

Icon

বিবিসি বাংলা

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৩৩ পিএম

ঢাকাই জামদানি যখন দিল্লি মাতিয়ে তুলেছে

২০২৫ সালের শুরুতে ‘উমরাওজান’ ছবির পুনর্মুক্তি উপলক্ষে পোস্টারের সামনে পরিচালক মুজফফর আলি ও অভিনেত্রী রেখা। ছবি: সংগৃহীত

বলিউডের কাল্ট মুভি 'উমরাওজানে' রেখা যে নবাবি শহর লখনৌতে এক তওয়াইফ বা বাঈজির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তা সিনেমাপ্রেমী মাত্রেই জানেন। কিন্তু 'দিল চিজ কেয়া হ্যায়' বা 'ইন আঁখো কি মস্তি'র মতো বিখ্যাত গানের কলির সেই নায়িকাকে যে সিনেমায় ঢাকাই জামদানি পরানো হয়েছিল, তা কজন খেয়াল করেছেন? 

তথ্যটা জানা ছিল না ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ’রও। দিল্লিতে বাংলাদেশের জামদানির প্রদর্শনী করার উদ্যোগ নিয়ে কিছুদিন আগে তিনি যখন উমরাওজানের পরিচালক মুজফফর আলির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, প্রস্তাবটা শুনেই লাফিয়ে ওঠেন বর্ষীয়ান নির্মাতা! 

গল্পচ্ছলে হামিদুল্লাহ্ বলছিলেন, ‘উনি বললেন, আমি তো আসবোই – আমি উমরাওজানে রেখাকে জামদানি পরিয়েছি ... আর দিল্লিতে জামদানি নিয়ে কাজ হলে আমি আসবো না? শুনে তো আমি যাকে বলে অভিভূত।’ 

মুজফফর আলি যথারীতি কথা রেখেছেন। দিল্লিতে হস্তশিল্পের সেরা সম্ভার যেখানে প্রদর্শিত হয়, সেই ন্যাশনাল ক্র্যাফটস মিউজিয়াম ও হস্তকলা অ্যাকাডেমিতে এই সপ্তাহান্তে বাংলাদেশি জামদানির প্রদর্শনীর উদ্বোধনে এসে হই হই করে শাড়ির সম্ভার দেখেছেন, সমঝদারের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি শাড়ির কাজের তারিফ করেছেন। জামদানি হলো এমন এক বিরল টেক্সটাইল যা বুনতে একটা সময় একসঙ্গে দু'জন তাঁতিকে লাগে–ওস্তাদ আর সাগরেদ-কারণ একজনে সে কাজ হয় না।

প্রদর্শনীতে সেই বিরল শিল্পশৈলী হাতেকলমে করে দেখাচ্ছিলেন যে তাঁতিরা, সেই যুগলের সঙ্গে মহা উতসাহে পোজ দিয়ে দেখলাম ছবিও তুলছেন মুজফফর আলি! ভারতের আরেক বিখ্যাত ইন্টিরিয়র ডিজাইনার সুনীতা কোহলি–যিনি দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত সাজিয়েছেন–তিনিও এই প্রদর্শনীর আরেক মেন্টর, বাংলাদেশের জামদানিকে যিনি দিল্লির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আসলে ভারতের রাজধানীতে বাংলাদেশের জামদানির এত বড় প্রদর্শনী স্মরণকালের মধ্যে তো নয়ই, সত্যি কথা বলতে আগে কখনেই হয়নি।

ক্র্যাফটস মিউজিয়ামের এই প্রদর্শনী অবশ্য ঠিক সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিক্রির জন্য নয়, বরং জামদানি বুননের অনন্য শিল্পটার সঙ্গে ভারতের শাড়ি-রসিকদের পরিচয় করিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশের অনন্য এক শিল্প অভিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতেই! পদ্মার ইলিশের জোগান যখন নানা কারণে অনিয়মিত, শীতলক্ষ্যা তীরের জামদানি হয়তো বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ভ্যালুকে বৃহত্তর ভারতের সামনে তুলে ধরতে পারবে–বিষয়টাকে এভাবেও দেখছেন প্রদর্শনীতে আগত অনেকেই! 'মাছের রাজা' ইলিশ না হয় না-ই বা পাওয়া গেল, 'শাড়ির রানি' জামদানিতে লোভ তো দেয়াই যায়!

কী বিশেষত্ব ঢাকাই জামদানির?

রিয়াজ হামিদুল্লাহ নিজেই বলেন, ‘আমি শাড়ি বিশেষজ্ঞ নই–কিন্তু জামদানির প্রেমে মজে আছি বহু বছর ধরেই!’ ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে বড়জোর ১৫-২০টা গ্রামেই শুধু হয় আসল জামদানির কাজ। আর এসব গ্রামগুলোই শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে। কিছু তো একটা আছে ওখানকার জলহাওয়ায়... শীতলক্ষ্যার আর্দ্রতা, ওই পানির বিশেষত্ব...ওটা ছাড়া বোধহয় জামদানি বোনাই যায় না!এমন কী এই তাঁতিদের অন্য কোথাও উঠিয়ে নিয়ে গিয়েও জামদানি করার চেষ্টা হয়েছে – বাংলাদেশেরই অন্য প্রান্তে, বা সীমান্তের অন্য পারেও! কিন্তু হয়ে ওঠেনি সেটা। আর এখানেই জামদানির অনন্যতা, এটা যে শীতলক্ষ্যা তীরেরই ফসল।’

কয়েকটা নির্দিষ্ট তাঁতি পরিবারই বহু বহু বছর ধরে বংশপরম্পরায় এই শিল্পের অনুশীলন চালিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, ‘আট-দশ বছর আগে প্রথম সেই পাড়ায় গিয়ে দেখেছিলাম জামদানির তাঁতিরা নিজেদের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটা ভাষায় কথা বলেন, যেটা বাইরের লোকের পক্ষে বোঝাই সম্ভব নয়! আর কালার প্যালেটের ওপর এক একটা শাড়ি বুনতে সাত দিন থেকে সত্তর দিন–এমন কী একশো সত্তর দিনও লাগতে পারে!


তার মন্তব্য, ‘তো জামদানিকে শাড়ি না বলে আসলে শিল্পকর্ম বলাই উচিত।’ রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, ‘কী জানেন, একটা জামদানি বুনতে বুনতে তাঁতির মাথায় হয়তো কিছু একটা ঝিলিক দিলো ... সে বুনট বদলে ফেলে মাঝপথে নতুন কায়দায় বুনতে শুরু করে দিল! এই জন্যই বলা হয় প্রতিটা জামদানি আসলে আলাদা এক একটা কবিতা!’

এই শিল্পরীতির সঙ্গে ভারতের বাঙালিদের কিছুটা পরিচয় থাকলেও দেশের অন্য ভাষাভাষীরা জামদানি নিয়ে কমই জানেন–আর তাদের সঙ্গে জামদানির আলাপ করাতেই দিল্লির ক্র্যাফটস মিউজিয়ামে বাংলাদেশ সরকারের এই আয়োজন।

কিউরেটর বন্ধু দুই চন্দ্রশেখরের গল্প

গত শতাব্দীর আশির দশকে আহমেদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইন থেকে স্নাতক হয়েছিলেন দুই চন্দ্রশেখর–চট্টগ্রামের চন্দ্রশেখর সাহা আর রাজস্থানের চন্দ্রশেখর ভেডা। সেই দুই কৃতী সহপাঠীর বন্ধুত্ব আজও অম্লান, আর তারা দুজনেই যুগ্মভাবে এই প্রদর্শনীর কিউরেটর। চন্দ্রশেখর সাহা বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্র্যান্ড 'আড়ং'-এর চিফ ডিজাইনার ছিলেন বহু বছর, এখন সেই প্রতিষ্ঠানে পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত। আর ভারতের নামী টেক্সটাইল ডিজাইনার চন্দ্রশেখর ভেডা 'স্পাইডার ডিজাইন' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। জামদানি কেন স্পেশাল, কেন অনন্য – তা ব্যাখ্যা করতে দুজনেই অক্লান্ত, কারণ এটা দুই চন্দ্রশেখরেরই প্যাশন।

চন্দ্রশেখর ভেডা যেমন বলছিলেন, ‘এই ফাস্ট ফ্যাশন, এআই, অটোমেশন বা স্পেশাল এফেক্টসের কারিকুরের যুগেও জামদানি সত্যিকারের হাতের কাজকে বাঁচিয়ে রেখেছে – কারণ কোনও প্রযুক্তি দিয়ে এই শৈলীকে রিপ্লেস করা যায়নি!’

চন্দ্রশেখর সাহা পাশ থেকে যোগ করেন, ‘এক সময় যারা পৃথিবীর সূক্ষতম টেক্সটাইল মসলিন বানাতেন, তাদের বংশধররাই কিন্তু আজ এই জামদানি শিল্পের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন ... গুরু ছাত্র পরম্পরায় এই ঘরানা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে!’

দুই কিউরেটর বন্ধুর কাছ থেকে আরও জানা গেল...জামদানি তৈরি হয় একদম 'বেসিক লুম' বা অতি সাধারণ তাঁতে – আর প্লেইন সাদামাটা ফেব্রিকের ওপর। কিন্তু এই শাড়ির আসল কারিকুরি তাঁতির মগজে, শিল্পীর ভাবনায়। এখন পর্যন্ত কোনও যন্ত্র বা পাওয়ার লুমে কোনও জামদানি তৈরি করা যায়নি, যাবেও না কোনোদিন।

জামদানির নকশায় লুকোনো থাকে অঙ্কের প্যাটার্ন, নামতার ছন্দ, কবিতার লাইনের মতো ওঠাপড়া–যার অনেকটা আবার শিল্পীরা মনে মনে মুখস্থ করে রাখেন। এই নকশার প্যাটার্নের কোনও লিখিত রূপ হয় না! জামদানি ভারতেরও নানা প্রান্তে তৈরি হয়, বেনারসে বা কলকাতার কাছেও–কোনোটায় প্লেইন লুম ব্যবহার হয়, কোনওটায় বাস্কেট লুম – উইভিং প্যাটার্নেও রকমফের আছে। কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে ঢাকাই জামদানির অবশ্যই বিস্তর পার্থক্য।

কিন্তু সব জামদানির মধ্যে বড় মিল একটাই – কোনো মেশিন বা যন্ত্র এখনও এই শিল্পটাকে নকল করতে পারেনি। আর এজন্যই সারা দুনিয়া জুড়ে শাড়ির সংগ্রাহকরা তাদের কালেকশনে একটা অন্তত খাঁটি জামদানি রাখতেই চান – কারণ জামদানি আর পাঁচটা দামি শাড়ির মতো নয়, এটা একটা শিল্পসৃষ্টি! চন্দ্রশেখর সাহা বলছিলেন,‘আমি বলি এটা হলো 'ওভেন আর্ট', তাঁতে বোনা শিল্প! তাঁতি তার সুখ-দু:খ, ভাললাগা-মন্দলাগার আবেগ, প্রকৃতির রংরূপ যেভাবে দেখেন–সব এক এক করে গাঁথতে থাকেন শাড়ির একটা নির্দিষ্ট আয়তনের ভেতর...এই শিল্পের তুলনা কোথায় বলুন!’


রফতানি পণ্য হিসেবে সম্ভাবনা কতটা?

কলকাতার অর্পিতা ভাদুড়ী 'সুতোর গল্প' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, তিনি ভারতের ক্রেতাদের কাছে ঢাকাই জামদানির পসরা মেলে ধরে আসছেন অনেকদিন ধরে। জামদানি আমদানি করছেন সরাসরি বাংলাদেশ থেকেও। ভাদুড়ী বলছিলেন, ‘আসল ঢাকাই মসলিন এখন অতি দুষ্প্রাপ্য–এক-আধখানা তৈরি হলেও ভারতে তার দাম ২০ লক্ষ রুপির কম নয়। কিন্তু সে জায়গায় হান্ড্রেড কাউন্টের রেশম সিল্কের ঢাকাই জামদানির দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে। ফলে 'পুওর ম্যান'স মসলিন' হিসেবেও তার কদর কম নয়। ভারতে এই ধরনের শাড়ির একটা ভাল বাজার তৈরিও হয়েছে।’

ঐতিহাসিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জামদানির ঐতিহ্যর সঙ্গে পরিচিত। ওই রাজ্যের ফুলিয়াতে জামদানির একটি প্রকারভেদ তৈরিও হয়। কিন্তু বাংলার বাইরে ভারতের শাড়িপ্রেমীদের মধ্যে জামদানির নতুন চাহিদা তৈরির অবকাশ আছে বলেও তিনি মনে করেন।

অর্পিতা ভাদুড়ী বলছিলেন, ‘আর জামদানির মজাটা কী জানেন? এটা এতোই অন্যরকম একটা শাড়ি, যে একেবারে সাধারণ মানুষও খালি চোখে দেখেই বুঝবেন এটা একেবারে আলাদা, অন্য কিছুর সঙ্গে এর তুলনাই চলে না। মানে ধরুন ভারতে তো নামীদামি শাড়ির অভাব নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষ দক্ষিণের কাঞ্জিভরমের সঙ্গে বাংলার গরদের খুব একটা তফাত ধরতে পারেন না। কিন্তু তারাও এটা বোঝেন যে জামদানি একেবারেই আলাদা!’

ফলে খুব 'ইউনিক' ও 'নিশ' প্রোডাক্ট বা 'কালেক্টর্স আইটেম' হিসেবে জামদানির একটা খুব ভালো বাণিজ্য সম্ভাবনা আছে বলেই মনে করেন তিনি। রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ’ও এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত। তবে তিনি সেই সঙ্গেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘এর বাণিজ্যিক দিক অবশ্যই আছে, কিন্তু জামদানিকে কখনোই একটা মাস প্রোডাক্ট হিসেবে দেখা উচিত নয়। কারণ প্রত্যেক জামদানির একটা আলাদা গল্প আছে–এটা বুঝতে হবে। কারখানায় একের পর এক জামদানি তৈরি করে রফতানি তো সম্ভব নয়, কাজেই এর এই বিরলতাটাকেই মর্যাদা দিতে হবে।’

রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলছিলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় কেউ একটা জামদানি দেখিয়ে তাঁতিকে বললেন, আমাকে ঠিক এরকমই একটা বানিয়ে দিন ... সেটা কিন্তু আসলে সম্ভবই নয়! তাঁতি তার মতো করেই করবেন ... বড়জোর বলতে পারেন, এই গোছের একটা কিছু করে দিন! তাহলে কি বাংলাদেশ তাদের 'ব্র্যান্ডিং'-এর জন্যই জামদানিকে ব্যবহার করছে? আমার কিন্তু ব্র্যান্ডিং শব্দটায় একটু আপত্তি আছে, ওটা কর্পোরেট কনসেপ্ট। বরং বলতে পারেন, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরতে যে অভিনব প্রতীকগুলো আমরা ব্যবহার করতে চাইছি, জামদানি তাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান!’

তিনি বলেন, মাস প্রোডাক্ট না হলেও মানুষ যদি এই অনন্য শিল্পকলাটির সঙ্গে পরিচিত হয় তাহলে চাহিদা তো নিশ্চয়ই বাড়বে–বিক্রি তখন আপনা থেকেই হবে। ভারতের রাজধানীতে যমুনার তীর ঘেঁষে ভারত মন্ডপমের এক কোণায় ন্যাশনাল ক্র্যাফটস মিউজিয়ামে বৃহত্তর ভারতের সঙ্গে জামদানির সেই পরিচয়পর্বই চলছে মহাধূমধামে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

দলগুলোর পছন্দের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচন পদ্ধতি: শফিকুল আলম

দলগুলোর পছন্দের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচন পদ্ধতি: শফিকুল আলম

বাংলাদেশকে দেখে শেখা উচিত পাকিস্তানের: কামরান আকমল

বাংলাদেশকে দেখে শেখা উচিত পাকিস্তানের: কামরান আকমল

সরকারি খরচে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন নুর

সরকারি খরচে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন নুর

ঢাকাই জামদানি যখন দিল্লি মাতিয়ে তুলেছে

ঢাকাই জামদানি যখন দিল্লি মাতিয়ে তুলেছে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App