ওয়াসার মেগা প্রকল্পে গুরুতর অনিয়ম: কাঠগড়ায় প্রকল্প পরিচালক ওয়াজ উদ্দিন

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম

ঢাকা ওয়াসার ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট’ প্রকল্পের পরিচালক ও সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ওয়াজ উদ্দিন। ফাইল ছবি
ঢাকা ওয়াসার অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট’ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ওয়াজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তি নবায়ন, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অফিসে অনুপস্থিতি এবং আর্থিক অনিয়মের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তার একচ্ছত্র আধিপত্যে সংস্থাটির প্রকৌশলীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের প্রাথমিক মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর এবং বাজেট ছিল প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। তবে বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে এবং ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকায়। প্রকল্প বিলম্বের কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি) অতিরিক্ত প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা জনগণের অর্থের অপচয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. ওয়াজ উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেছেন, এডিবি নিজেই সময় বেশি নিয়েছে এবং তারা সার্ভে ও টেন্ডার করতে করতে প্রকল্পের সময় বেড়ে গেছে। প্রকল্পের ব্যয় বাড়েনি শুধুমাত্র ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি খরচ হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের ঘনিষ্ঠতা এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সুপারিশে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রকৌশলী ওয়াজউদ্দিনকে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে অনেক জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য প্রকৌশলী পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সুপারিশে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পিডি হওয়ার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, আমি এই প্রকল্পের পঞ্চম পিডি। আমার আগে যারা ছিলেন তারা ফেইল করেছিলেন বলে আমাকে অনুরোধ করে পিডি করেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সোডেভ ডেভকন কনসাল্টিং লিমিটেডের মূল কাজ শেষ হলেও তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই নতুন চুক্তি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে, বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড এবং সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে ডেটা সেন্টার ও ডিপ টিউবওয়েল এসসিএডিএ (প্যাকেজ আইসিবি ১.২ – ইউনিফাইড স্কাডা অবকাঠামো ইনস্টলেশন এবং কমিশনিং এবং প্যাকেজ আইসিবি ১.৪ – গভীর নলকূপের স্থাপন এবং কমিশনিং স্কাডা) স্থাপনের কাজ দেওয়া হয়। তবে টেন্ডার ছাড়া তাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে কিনা প্রশ্নে মো. ওয়াজ উদ্দিন বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই।
অভিযোগ রয়েছে, এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কাজের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হলেও প্রকল্প পরিচালকের একক সিদ্ধান্তে বারবার সময় বাড়ানো হয়েছে, যা জুন ২০২৫ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। প্রতিটি মেয়াদ বৃদ্ধির সময় অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগও উঠেছে। এমনকি, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কাজ অসম্পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও বেক্সিমকোকে অতিরিক্ত বিল প্রদান করে প্রকৌশলী ওয়াজউদ্দিন বিপুল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেছেন বলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রকৌশলী ওয়াজউদ্দিন ঢাকা ওয়াসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবেও দীর্ঘ সাত বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক এমডি তাকসিম এ খানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কোনো নির্বাচন ছাড়াই তিনি এই পদ দখল করেন এবং সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে সংগঠনটিকে কার্যত একক নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। ভিন্নমত পোষণকারী প্রকৌশলীদের হয়রানি ও বদলির শিকার হতে হয় বলেও একাধিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করায় প্রকাশ্যে কেউ অভিযোগ করতে সাহস পাচ্ছেন না।
ভোরের কাগজের হাতে আসা প্রকল্প অফিসের হাজিরা খাতা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকৌশলী ওয়াজউদ্দিন গত বছর নভেম্বর মাসে মাত্র ৮ দিন অফিস করেছেন। তার বিরুদ্ধে অফিসে নিয়মিত অনুপস্থিতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে তিনি এই দাবি অস্বীকার করেন এবং বলেন এটা সঠিক না; আমি সব সময় অফিস করেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রকৌশলী ওয়াজ উদ্দিন আওয়ামী লীগের পক্ষে, বিশেষত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুরের জন্য বিশেষ অনুদান দিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। এই রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি বিভিন্ন সুবিধা আদায় করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে এই অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এসব অনিয়মের বিষয়ে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকৌশলী ওয়াজউদ্দিনের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে প্রকৌশলী মো. ওয়াজ উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে এমডি ও পিআরও-এর অনুমতি নিয়ে কথা বলবেন বলে জানান। প্রতিবেদককে অফিসে চা পান করার নিমন্ত্রণ জানান এবং অধিকাংশ অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।
প্রসঙ্গত, ঢাকা শহরবাসীকে সার্বক্ষণিক নির্ভরযোগ্য পানির সরবরাহ এবং ঢাকা ওয়াসার সেবার মান ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতেই ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসার সাতটি জোনের সকল পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক ও গ্রাহক সাধারণের পানির সংযোগ পুনর্বাসন, শক্তিশালী করে ডিস্ট্রিক্ট মিটাররিং এরিয়া (ডিএমএ) প্রতিষ্ঠা করে স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী, বস্তিবাসীসহ সকল নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহ করা এবং নন-রেভিনিউ ওয়াটার (এনআরডব্লিউ)-এর পরিমাণ নিম্নতর পর্যায়ে কমিয়ে আনার জন্য এই প্রকল্পটির উদ্যোগ নেয়া হয়।