খাদ্যচক্রে ভারী ধাতু নীরবে মৃত্যুর পথে নিচ্ছে মানুষকে

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৩১ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
চাল, আলু, চাষের মাছ, ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি, ডিম, শাক-সবজি, দুধ, টি-ব্যাগ, প্লাস্টিকের কাপ-বোতল থেকে শুরু করে নানা পণ্যে ভারী ধাতুর উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। এমনকি পানির মধ্যেও মিলেছে ভারী ধাতু। আরো অবাক করা বিষয় হলো- কীটনাশকের মধ্যেও রয়েছে জীব জগতের জন্য ক্ষতিকর এই উপাদান। মানুষের খাদ্যচক্রে এসব ভারী ধাতু অনেক আগেই ঢুকে পড়েছে। এর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান না হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। তবে সেজন্য নির্দিষ্ট কোনো ফসল বা খাদ্যপণ্য নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে খাদ্য উৎপাদনের উৎসে বিষ ছড়ানোর সুযোগ বন্ধ করতে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর টক্সিক সাবসটেন্স অ্যান্ড ডিজিজেস রেজিস্ট্রি (এটিএসডিআর) ভারী ধাতুগুলোর মধ্যে পারদ, আর্সেনিক, সিসা, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়ামকে জনস্বাস্থ্যের জন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আবার তামা, লোহা, দস্তা, নিকেলের মতো কিছু ধাতু প্রাণীদেহের বিপাকীয় কাজের জন্য দরকারি। কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় শরীরে এলে সেগুলোও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
জীবাশ্ম জ্বালানি, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পকারখানা, ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য থেকে পরিবেশে ভারী ধাতু মিশতে পারে, যা পৌঁছাতে পারে চাষের জমিতে। এর বাইরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাধ্যমে ভারী ধাতু মাটিতে জমতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ভারী ধাতু মাটিতে অণুজীবের টিকে থাকার পরিবেশ বদলে দেয়, উদ্ভিদের ডিএনএর গঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত ফসলের মাধ্যমে মানুষের দেহে পৌঁছে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষক দল বেশ কয়েক বছর যাবত চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের নানা রকমের চাল, বেগুন, পালং শাক, মুরগি ও গরুর মাংস, রুই ও তেলাপিয়া মাছসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে চালে। এরপর পালং শাক, বেগুনেও। ২০২৫ সালে আগস্ট মাসে বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) পরিচালিত এক গবেষণায়, দেশের খামারের মুরগির মাংস ও ডিমে ক্রোমিয়াম, সিসা ও ক্যাডমিয়ামসহ ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে। মুরগির মাংসে প্রতি কেজিতে সিসার পরিমাণ পাওয়া গেছে শূণ্য দশমিক ৩ মিলিগ্রাম (মি.গ্রা.), যা আন্তর্জাতিক সহনীয় মাত্রার (শূণ্য দশমিক ১ মি.গ্রা.) চেয়ে তিনগুণ বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ধাতুর উৎস হিসেবে মুরগির খাদ্যে ব্যবহৃত ভুট্টা ও খামারের পানিতে এ ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। বলা হয়, ভুট্টার ১৫ শতাংশ নমুনায় ক্রোমিয়াম, ২০ শতাংশে সিসা এবং ৫ শতাংশে ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে। সোনালি মুরগির খামারের ভুট্টায় সিসা ও ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে, ভূগর্ভস্থ পানির নমুনার ৩১ শতাংশে ক্রোমিয়াম, ৬৩ শতাংশে সিসা এবং ৫৪ শতাংশে ক্যাডমিয়াম শনাক্ত হয়েছে। প্রতি লিটার পানিতে সিসার পরিমাণ মিলেছে শূণ্য দশমিক শূণ্য ২ মি.গ্রা., যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহনীয় মাত্রা শূণ্য দশমিক শূণ্য ৩ মি.গ্রা.। এর আগেও এক গবেষণায় ব্রয়লার মুরগির মধ্যে ভারী ধাতু ও অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি মিলেছিল। এরপর বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে কৃষি মন্ত্রণালয়। সেই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ব্রয়লার মুরগি নিরাপদ। যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে, তা সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রার চেয়ে ‘অনেক কম’।
২০২৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা, ঈশ্বরগঞ্জ, ফুলপুর ও গফরগাঁওয়ের মোট ২৪টি এলাকায় কৃষকের খেত থেকে আলু ও আলু উৎপাদনের মাটির নমুনা সংগ্রহ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। গবেষকরা, আলু ও আলু উৎপাদনের মাটিতে ক্ষতিকর মাত্রায় নিকেল ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন। গবেষণায় প্রতি গ্রাম আলুতে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৯৩৮ মাইক্রোগ্রাম নিকেল ও শূণ্য দশমিক শূণ্য ১৩৯ মাইক্রোগ্রাম ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। যদিও এ দুটি ধাতু সামান্য পরিমাণ গ্রহণও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। গবেষণায় উঠে এসেছে, জমিতে শিল্পবর্জ্য, সেচের পানি, সার ও কীটনাশক ইত্যাদির মাধ্যমে আলুর মধ্যে এসব ক্ষতিকর ভারী ধাতু মিশতে পারে। গবেষণা প্রতিবেদনটি পরবর্তীতে ডাচ একাডেমিক প্রকাশক ‘এলসেভিয়ার’-এ প্রকাশিত হয়।
২০২৪ সালে প্রকাশিত বাকৃবির এক গবেষণায় লালশাক ও শিম, শসা, ঢেঁড়স, পটলের মতো সবজিতে মিলছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু। শুধু শাক-সবজি নয়, আম, লিচুসহ অন্যান্য ফলেও কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই বছর প্রকাশিত হয় ‘কার্সিনোজেনিক অ্যান্ড নন-কার্সিনোজেনিক হেলথ হ্যাজার্ডস অব পোটেনশিয়াল টক্সিক এলিমেন্টস ইন কমনলি কনজিউমড রাইস কাল্টিভার্স ইন ঢাকা সিটি, বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন। তাতে, মিনিকেট আর নাজিরশাইলের মতো চালের নমুনাতে ক্ষতিকারক মাত্রায় আর্সেনিক, সিসার মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালে উত্তরের জেলা নাটোরের একটি বাণিজ্যিক খামারের রুই, মৃগেল, সিলভার কার্প, বাটা ও পুঁটি মাছের ওপর গবেষণা পরিচালিত হয়। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (এফআরআই) ও বাকৃবির দুজন গবেষকের মাধ্যমে পরিচালিত সে গবেষণায় চাষের মাছে ভারী ধাতুর উপস্থিতির সন্ধান পাওয়া যায়। এ গবেষণায় দেখা গেছে চাষের মাছের মধ্যে মৃগেলে ক্রোমিয়াম মিলেছে নিরাপদ সীমার চেয়ে চার গুণ, যেখানে এফএওর তথ্য বলছে, খাবারে ক্রোমিয়াম দশমিক ১৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত সহনীয়।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবির) গবেষকদের করা এক গবেষণায় প্লাস্টিক কাপ ব্যবহারে মিলছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু। বিভিন্ন একক ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক কাপে চা, কার্বনেটেড কোমল পানীয়, লাচ্চিসহ বিভিন্ন রকম পানীয় যথাক্রমে এক, পাঁচ ও দশ মিনিট ধরে রেখে পরীক্ষা করে ২০টি নমুনার ১৭টিতেই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। এসব ধাতুর মধ্যে কপার, লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম অন্যতম। পরবর্তীতে গবেষণাপত্রটি ‘হেলিওন’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
২০২২ সালে বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতির প্রমাণ পান বাকৃবি’র গবেষক দল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে ওই গবেষণাটি জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার মাটি ও বেগুন নিয়ে করা হয়। ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামালপুরের যেসব এলাকার বেগুন ক্ষেতে ওই গবেষণা করা হয়েছে, সেখানকার মাটিতে সিসা, নিকেল, ক্যাডমিয়াম, তামা ও দস্তা পাওয়া গেছে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি।
কৃষিকাজে কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের জন্য। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, বাজার থেকে সংগ্রহ করা ৪৭ ব্র্যান্ডের আমদানি করা কীটনাশকের নমুনা পরীক্ষা করে সীসা, ক্যাডমিয়াম, ক্রমিয়ামের মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে।
২০১৯ সালে বাজারে থাকা ২৬ ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধ পরীক্ষা করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। সেখানেও সিসার উপস্থিতি মিলেছিল। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, তা সহনীয় মাত্রায় রয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) একটি গবেষণা প্রতিবেদন। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া জনপ্রিয় টি-ব্যাগে বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা ১৩টি নমুনার মধ্যে ১২টি টি-ব্যাগ ও একটি খোলা চা পাতা পরীক্ষায় দেখা যায়, টি-ব্যাগের প্যাকেজিংয়ে অনুমোদিত সীমার বহু গুণ বেশি পরিমাণে ভারী ধাতু রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ভারী ধাতু মানবদেহে সামান্য পরিমাণে প্রবেশ করাও বিপজ্জনক। স্বল্প সময় কিংবা দীর্ঘ সময় ভারী ধাতুর সংস্পর্শে এলে মস্তিষ্ক, বৃক্ক, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপিণ্ড, পরিপাকতন্ত্রে নানারকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। হতে পারে ক্যান্সার। ভারী ধাতু যখন খাবারের মাধ্যমে দেহে ঢোকে, তখন তা অনেক ক্ষেত্রে বমি, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, স্নায়ুবৈকল্য, দৃষ্টি ও শ্রবণে সমস্যা, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা প্রকাশ পায়। আবার বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভারী ধাতুর কণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে দেহে ঢুকতে পারে। ফলে হতে পারে শ্বসনতন্ত্রের সমস্যা। কিন্তু ভারী ধাতুর মূল প্রভাব আমাদের কোষে। কোষের ডিএনএর গঠন নষ্ট করে ফেলে এসব ধাতু। আবার মাইটোকন্ড্রিয়ার কাজে বাধা দেয়ার মাধ্যমে দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এর ফলে হতে পারে মৃত্যুও।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, দেশে ক্যান্সার রোগী বাড়ার অন্যতম কারণ পোলট্রি মুরগির খাদ্যে ক্ষতিকর ভারী ধাতু। এ কারণে কোলন ক্যান্সার, পাকস্থলী ক্যান্সার ও খাদ্যনালিতে ক্যান্সারের রোগী দেশে বাড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, মানুষের খাদ্যচক্রে এসব ভারী ধাতুর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান না হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। ভারী ধাতুর কারণে কিডনি সমস্যা, ক্যান্সারের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। আবার অনেকে যৌন ক্ষমতা হারান। এছাড়া মানুষের শরীরে যে ইনসুলিন তৈরি হয়, সেই প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। এতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন অনেকে। তবে নির্দিষ্ট কোনো ফসল বা খাদ্যপণ্য নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে খাদ্য উৎপাদনের উৎসে বিষ ছড়ানোর সুযোগ বন্ধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে এই প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, একই সঙ্গে ভারী ধাতু নিয়ন্ত্রণে সার ও কীটনাশক ব্যবহার ‘নিরাপদ’ করতে হবে। আমদানি করা কীটনাশকে ভারী ধাতু যেন না থাকে, তা-ও নিশ্চিত করা জরুরি।
বাকৃবির কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী ফরহাদ কাদেরের মতে, খাবারে ক্ষতিকর ধাতুর উপস্থিতি কামানোর উপায় খুঁজতে আরো গবেষণার প্রয়োজন। ক্ষতিকর এই পদার্থ খাবারে এবং খাদ্যচক্রে যাতে অতি মাত্রায় না যেতে পারে, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন।