×

অর্থনীতি

সার সংকটে বিপাকে কৃষক

Icon

হরলাল রায় সাগর

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:২৮ পিএম

সার সংকটে বিপাকে কৃষক

ছবি: সংগৃহীত

সারাদেশে আমনের ভরা মৌসুম চলছে। কিন্তু কৃষক সার পাচ্ছেন না। আবার অতিরিক্ত টাকা দিলে ঠিকই মিলছে সার। কৃষকদের অভিযোগ, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে সারের কৃত্রিম সংকট চলছে। তারা কেজিতে ৪-১০ টাকা বেশি নিচ্ছে। বরাবরের মতো ডিলার সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। ডিলারদের দাবি, সারের সরবরাহ বা বরাদ্দ কম; তাই কৃষকদের চাহিদামতো বিক্রি করা যাচ্ছে না। তাছাড়া আমনের সময় সারের চাহিদা বেড়ে যায়। মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে সারের কোনো ঘাটতি নেই। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। কিন্তু সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলেও সার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বহাল রয়েছে। এদিকে কৃষকরা সারের দাবিতে বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভও করেছেন। আমন ক্ষেতে প্রয়োজনীয় সার দিতে না পারায় ক্ষুব্ধ কৃষকরা। ফলে আমন উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। 

আমনের ভরা মৌসুমে সার পেতে চরম ভোগান্তির অভিযোগ তুলেছেন বিভিন্ন জেলার অনেক কৃষক। বিশেষ করে, ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট), টিএসপি এবং ইউরিয়া সারের জন্য ডিলার পয়েন্ট ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ঘুরে শূন্য হাতে ফেরার অভিযোগ করেছেন তারা। এমনকি কুড়িগ্রামের ভ‚রুঙ্গামারীতে সারের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিলও করেছেন স্থানীয় অনেকে। তাদের দাবি, আমনের ভরা মৌসুমে ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি সারের ঘাটতি চরম আকার ধারণ করেছে। দোকানে দোকানে ঘুরেও চাহিদা অনুযায়ী সার মিলছে না।

কৃষকদের দাবি, সরকার নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আমন আবাদের ক্ষেতে সার প্রয়োগের এখন উপযুক্ত সময়। এখনই জমিতে সার প্রয়োগ না করলে ফলন ভালো হবে না। সারের অভাবে ক্ষেতে ধানের রং বিবর্ণ, শীষ গঠন ও দানা পরিপক্বতার ক্ষেত্রে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলন কম হলে তাদের বিপদে পড়তে হবে। এক বিঘা জমিতে আমন ধান চাষের জন্য যে পরিমাণ সার প্রয়োজন, চাহিদা অনুযায়ী সেটা দেয়া হচ্ছে না। আবার বিঘাপ্রতি ডিলাররা সার দিচ্ছে ১০ কেজি করে। অভয়নগরের কৃষক শাহাজান বলেন, সার সংকটের কারণে চাষাবাদ নিয়ে চিন্তার মধ্যে আছেন। তার অভিযোগ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির কারণে সময় মত সার আমদানি না করায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 

কৃষকরা জানান, সরকার নির্ধারিত প্রতি বস্তা টিএসপি সারের দাম ১৩৫০ টাকা, এমওপি ১০০০ টাকা এবং ডিএপি ১০৫০ টাকা। সরকার নির্ধারিত দরে প্রতি কেজি ইউরিয়া সার বিক্রি করার কথা ২৭ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা ও এমওপি ২০ টাকায়। অথচ খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ২৯-৩২ টাকা, টিএসপি ৩৫-৪২ টাকা, ডিএপি ২৬-৩০ টাকা ও এমওপি ২৪-২৬ টাকায়।

অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনেছেন অনেকে। ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধেও সিন্ডিকেট করে সারের দাম বাড়ানোর অভিযোগ তুলছেন কৃষকরা। সার নিয়ে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে বিভিন্ন জেলার কৃষকদের কাছ থেকেই। কেউ বলছেন সার পাচ্ছেন না, আবার কারো অভিযোগ নির্ধারিত দামের চেয়ে বস্তাপ্রতি অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে। 

রাজবাড়ীর কৃষক মো. আকুর মণ্ডল জানান, বস্তাপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনেছেন তিনি। বেশি টাকা দিয়ে সার কেনার অভিযোগ করেছেন পিরোজপুরের কৃষক রাজন মিয়াও। এমনকি ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধেও সিন্ডিকেট করে সারের দাম বাড়ানোর অভিযোগ তুলছেন কেউ কেউ।

কুড়িগ্রামের কৃষক আবেদ আলী সরদার জানান, এ বছর ভরা আমনের মৌসুমে সার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তিন দিন ধরে বাজারে ঘুরে পরে বাড়তি দামেই সার কিনেছেন তিনি। দুই-তিন দোকান ঘুরেও ডিএপি সার পাননি। এক জায়গায় ১৯০০ টাকা বস্তা চেয়েছে। পরে ৩২ টাকা কেজিতে অল্প পরিমাণে কিনেছেন। আরেক কৃষক বলেন, ডিলার বলে সার নাই। আমি তো বাজারের দোকানে সার দেখছি, অনেক বেশি দাম দিয়ে বিক্রি হচ্ছে। কৃষক দবির ভুঁইয়া বলছেন, টাকা দিয়ে সার কিনব, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। দামের কারণে এখনো জমিতে সার দিতে পারিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রামের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের দাবি, কৃষকরা তাদের যে সার প্রয়োজন সেটা একসঙ্গে ক্রয় করতে চাইছেন। এক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, বাজারের খুচরা বিক্রেতারা লোকজন দিয়ে ডিলারদের কাছ থেকে সরকারি সার ক্রয় করে তা বেশি দামে বাজারে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের পর মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে অভিযুক্তদের জরিমানাও করা হয়েছে।

যশোরের একাধিক চাষি অভিযোগ করেন, প্রথমে সার পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে টাকা বেশি দেয়ার পর সার পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, ডিলাররা চাহিদা অনুযায়ী সার দিচ্ছেন না। বলছেন সার নেই। আর ডিলারদের দাবি, আমন মৌসুমের শুরু থেকেই কৃষকদের চাহিদার তুলনায় তাদের কাছে সারের সরবরাহ কম। টিএসপি সারের চাহিদা বেশি থাকলেও সরবরাহ কম থাকায় তারা কৃষকদের কম দিয়েছেন। 

যশোর জেলা বিএফএর সভাপতি মো. শাহাজালাল বলেন, সার আমদানিতে টেন্ডার আহ্বান করতে দেরি করায় সার সংকট দেখা দিয়েছে। সঠিক সময় টেন্ডার করলে এই অবস্থা হতো না।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আলমগীর বিশ্বাস বলেন, সারের সরবরাহ তো সব সময় একসঙ্গে থাকে না। পর্যায়ক্রমে আসতে থাকে। সারের কোনো সংকট নেই। ডিলারের ঘরে সার রয়েছে। কেউ সংকটের কথা বলে থাকলে এটা মূলত আতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই বলে থাকতে পারে। আতঙ্ক সৃষ্টি করে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ও কৃষক সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আহসানুল আরেফিন তিতু বলেন, টিএসপি ও এমওপিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সারের কৃত্রিম সংকট এবং অতিরিক্ত দামের কারণে একদিকে কৃষি ফসলের উৎপাদন খরচ খুব বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে যথাসময়ে সার না পাওয়ার কারণে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতি বস্তা টিএসপি সারের সরকারি মূল্য ১৩৫০ টাকা হলেও কৃষকের কাছে তা ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। অন্য সারের দামও বেশি নেয়া হচ্ছে। 

সারাদেশে সারের ডিলার নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। দেশে দুই সংস্থার মোট অনুমোদিত ডিলার আছে ৭ হাজার ১০০-এর বেশি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিএডিসি নন-ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার সরবরাহ করে। বিএডিসির পাশাপাশি নন-ইউরিয়া সার আসে বেসরকারি আমদানিকারকের মাধ্যমেও। আর বিসিআইসি স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে ইউরিয়ার জোগান দেয়। কিন্তু সরকারের দুটি সংস্থা ডিলার নিয়োগ দিলেও কৃষকদের জিম্মি করে অনিয়ম করে চললেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা খুবই কম নিতে দেখা গেছে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি সেপ্টেম্বরে ৬৪ জেলায় চাহিদার বিপরীতে নন-ইউরিয়া টিএসপি ৪৫ হাজার ৪৬৮ টন, ডিএপি ৯১ হাজার ৩৫৩ টন এবং এমওপি ৬৭ হাজার ৭৪৯ মে. টন বরাদ্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী অক্টোবরের জন্যও এসব সার ইতোমধ্যে বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে টিএসপি ৬৮ হাজার ৮৯টন, ডিএপি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৭৫ টন এবং এমওপি ৯০ হাজার ২৮৯ মে. টন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। বর্তমানে অন্তত ১৬ লাখ টন সার মজুত রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ৫ লাখ ১৫ হাজার মে. টন নন-ইউরিয়া সার আমদানি কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে মোট ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে।

আরো অন্তত সাড়ে ৪ লাখ টন সার আমদানির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।  

সার নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের অভিযোগ থাকলেও, কোনো সংকট নেই বলে দাবি কৃষি মন্ত্রণালয়ের। তারা বলছে, প্রতি বছর চাহিদা যখন বেশি থাকে, তখন অতিরিক্ত লাভের আশায় একটা মহল সারের কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করে।

মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সল ইমাম বলেন, প্রতিটি এলাকায় চাহিদার ভিত্তিতে অনেক আগে থেকেই সারের সরবরাহ নিশ্চিত করা থাকে। আমাদের সারের কোনো সংকট নেই। সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক ভাবেই অব্যাহত আছে। তার দাবি, কেবল সার নয়; কৃষি উপকরণ নিয়ে যেসব অসাধু চক্র সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করছে সবসময়ই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, আমাদের সারের কোনো সংকট নেই। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সারের প্রয়োজন তা আছে। এই মৌসুমে আমাদের সারের কোনো সংকট নেই। তিনি বলেন, সার নিয়ে আমাদের সচেতনতা লাগবে। মানুষের ব্যবহারের মধ্যে একটু সচেতনতার অভাব আছে। আমরা কৃষকদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, একটি জমিতে কী পরিমাণ সার আসলে প্রয়োজন। আমরা একটি খামারি অ্যাপ চালু করেছি। সে জমির ধরন অনুযায়ী কৃষক কী ধরনের কতটুকু সার ব্যবহার করতে পারবেন সেটি জানতে পারবেন। অতিরিক্ত সার দেয়া মানে জমির জন্য ক্ষতি এবং কৃষকের অর্থের অপচয়। অন্যদিকে সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কেউ বেশি দামে বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

খাদ্যচক্রে ভারী ধাতু নীরবে মৃত্যুর পথে নিচ্ছে মানুষকে

খাদ্যচক্রে ভারী ধাতু নীরবে মৃত্যুর পথে নিচ্ছে মানুষকে

‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরান গ্রেফতার

‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরান গ্রেফতার

প্রবাসীদের ভোট দেয়ার প্রক্রিয়া প্রকাশ করলো ইসি

প্রবাসীদের ভোট দেয়ার প্রক্রিয়া প্রকাশ করলো ইসি

পিছিয়ে গেল রাকসু নির্বাচন

পিছিয়ে গেল রাকসু নির্বাচন

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App