বন্দুকের মুখে মুসলিমদের পুশ ইন করছে ভারত: বিবিসি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ০১:৫৪ পিএম

মুসলিমদের পুশ ইন করছে ভারত
বন্দুকের মুখে মুসলিম নাগরিকদের সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পুশ ইন বা ঠেলে দিচ্ছে ভারত। মূলত দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বিরুদ্ধেই উঠেছে মুসলিম নাগরিকদের ফের অবৈধভাবে বিতাড়নের অভিযোগ।
এছাড়া আসামে নাগরিকত্ব সঙ্কটেও পড়েছে মুসলিম পরিবারগুলো। বৃহস্পতিবার (৫ জুন) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, শোনা বানু এখনো কাঁপতে থাকেন গত কয়েকদিনের কথা ভাবলে। আসামের বারপেটা জেলার ৫৮ বছর বয়সী এই নারী জানান, গত ২৫ মে তাকে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর পুলিশ তাকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং আরও প্রায় ১৩ জনের সঙ্গে তাকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে বাধ্য করা হয়।
তিনি জানান, তাকে কোনো কারণ বলা হয়নি। কিন্তু তিনি জানতেন, এ রকম কিছু ঘটতে পারে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন প্রমাণ করতে যে তিনি বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, বরং একজন ভারতীয় নাগরিক।
শোনা বানু চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমাকে বন্দুক দেখিয়ে (বাংলাদেশের দিকে) ঠেলে পাঠানো হয়। এরপর দু’দিন কোনো খাবার বা পানি ছাড়াই হাঁটু-পানিওয়ালা মাঠে মশা আর জোঁকের মধ্যে পড়েছিলাম।
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তের মাঝখানে ওই ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’-এ দু’দিন কাটানোর পর তাকে ও আরও কয়েকজনকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ এক পুরোনো জেলখানার মতো এক জায়গায় নিয়ে যায়।
সেখানেও দু’দিন থাকার পর, তাদের মধ্যে কিছু লোককে আবার সীমান্ত পার করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
শোনা বানু জানেন না, তার সঙ্গে যারা ছিলেন, তাদের সবারই একই পরিণতি হয়েছে কিনা। কেন তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে আবার ফেরত আনা হলো, তা স্পষ্ট নয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আসামে এমন আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে ‘বিদেশি’ ঘোষিত ব্যক্তিদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ‘ঠেলে দেওয়া’ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিবিসি বলছে, কমপক্ষে ছয়টি ঘটনায় পরিবারের সদস্যদের এইভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে, যাদের পরে সীমান্ত পার করে দেওয়া হয়।
এই বিষয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), আসাম পুলিশ কিংবা রাজ্য সরকার— কারও পক্ষ থেকেই বিবিসিকে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।
অবশ্য ভারতে বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বিরুদ্ধে অভিযান নতুন নয়। প্রায় ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত অনেকাংশেই ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনুপ্রবেশের সুযোগ রয়েছে, যদিও কিছু এলাকায় কড়া পাহারা থাকে।
তবে আইনজীবীরা বলছেন, কাউকে হঠাৎ বাড়ি থেকে তুলে এনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা এখনও বিরল। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে এসব অভিযান অনেক বেশি বাড়ছে।
বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বরাতে দাবি করা হয়েছে, গত মে মাসে ভারত ১২০০ জনেরও বেশি মানুষকে ‘অবৈধভাবে ঠেলে দিয়েছে’ বাংলাদেশে। আর এটা শুধু আসাম থেকেই নয়, অন্য রাজ্য থেকেও। তাদের মধ্যে ১০০ জনকে বাংলাদেশের সরকার ভারতীয় নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করে ফেরত পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, তারা এই ধরনের পুশ ইনের প্রচেষ্টা ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে। অন্যদিকে ভারত সরকার এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করেনি।
বিবিসি বলছে, ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চলছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু আসামের পরিস্থিতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। কারণ এখানে নাগরিকত্ব ও জাতিগত পরিচয় দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তবর্তী আসামে স্বাধীনতার আগে ও পরে বহু মানুষ সুযোগের খোঁজে বা ধর্মীয় নির্যাতন থেকে বাঁচতে এসে বসতি গড়েন। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয় যে, জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং তাদের সম্পদ ও সুযোগ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
ভারতে ও আসামে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বহুবার এই ‘অনুপ্রবেশ’ রুখে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) তৈরিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এনআরসি অনুযায়ী, যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে আসামে এসেছেন, কেবল তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
তবে এই প্রক্রিয়াটি জটিল ও বিশৃঙ্খল। ২০১৯ সালে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হলে দেখা যায়, রাজ্যটির প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাদ পড়ে গেছেন।
অনেককে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়, আবার কেউ কেউ উচ্চ আদালতে আপিল করেন। শোনা বানু বলেন, তার মামলাও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ছিল, কিন্তু তারপরও তাকে (পুশ ইনের জন্য বাংলাদেশ) সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বিবিসি বলছে, কমপক্ষে ছয়টি মুসলিম পরিবার এমন ঘটনার কথা জানিয়েছেন বিবিসিকে। তারা বলছেন, তাদের প্রিয়জনদের সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যদিও তাদের সব বৈধ কাগজপত্র ছিল এবং তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করে আসছেন।
এইসব পরিবারগুলোর অন্তত চারজন সদস্য এখন আবার বাড়ি ফিরেছেন, কিন্তু তাদের এখনো জানানো হয়নি কেন তাদের তুলে নেওয়া হয়েছিল।
মূলত আসামের ৩ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই মুসলিম। তাদের অনেকেই ব্রিটিশ আমলে আসামে এসেছিলেন। ৬৭ বছর বয়সী মালেকা খাতুন — যিনি এখনও বাংলাদেশে রয়েছেন — জানান, তিনি সেখানে (বাংলাদেশে) একটি স্থানীয় পরিবারের আশ্রয়ে আছেন।
তিনি বলেন, আমার এখানে কেউ নেই। তার পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু তাকে ফেরত আনা সম্ভব হবে কিনা, তা তারা জানেন না। তিনি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ও হাইকোর্টে মামলায় হেরেছেন এবং সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেননি।
সম্প্রতি রাজ্য সরকার পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার কয়েকদিন পর, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জানিয়ে দেন, সুপ্রিম কোর্টের ফেব্রুয়ারির নির্দেশ অনুসারে যারা বিদেশি ঘোষিত হয়েছেন কিন্তু ডিটেনশন সেন্টারে রয়েছেন, তাদের ডিপোর্টেশন (বিতাড়ন) শুরু করতে হবে।
শর্মা বলেন, যারা বিদেশি হিসেবে ঘোষিত হয়েছেন কিন্তু আদালতে আপিল করেননি, আমরা তাদের (বাংলাদেশের দিকে) ঠেলে দিচ্ছি। যাদের মামলা বিচারাধীন, তাদের হয়রানি করা হচ্ছে না।”
তবে আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ভূইয়া অভিযোগ করেছেন, এসব অভিযানে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মানা হচ্ছে না। তার মতে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বয়ের কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। তিনি বলেন, “আদালতের নির্দেশকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে এসব করা হচ্ছে।”ভূইয়া সম্প্রতি একটি ছাত্র সংগঠনের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছেন, যেখানে ‘বাধ্যতামূলক ও অবৈধ পুশ ইনের বা ঠেলে দেওয়ার নীতি’ বন্ধ করতে হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে। তবে আদালত তাকে প্রথমে আসাম হাইকোর্টে যেতে বলেছে।
বারপেটা থেকে প্রায় ১৬৭ কিমি দূরে অবস্থিত মরিগাঁওয়ের বাসিন্দা রীতা খাতুন টেবিলের ওপর স্তূপ করে রাখা নথিপত্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার স্বামী খাইরুল ইসলাম — যিনি একজন স্কুলশিক্ষক — শোনা বানুর সঙ্গেই সীমান্তে পাঠানো দলের সদস্য ছিলেন।
২০১৬ সালে এক ট্রাইব্যুনাল তাকে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করেছিল। এরপর তিনি দু’বছর ডিটেনশন সেন্টারে ছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পান। তার মামলাও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। স্বামীর স্কুল সার্টিফিকেট ও জমির কাগজ দেখাতে দেখাতে রীতা বলছিলেন, “আমার স্বামীর প্রতিটি নথি তার ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ। কিন্তু এসব যথেষ্ট ছিল না।”
রীতার দাবি, তার স্বামী, তার শ্বশুর ও শ্বশুরের বাবা — তিনজনেই ভারতে জন্মেছেন। গত ২৩ মে পুলিশ তাদের বাড়িতে গিয়ে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই খাইরুলকে তুলে নিয়ে যায়।
কিছুদিন পর, একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে দেখা যাচ্ছে এক বাংলাদেশি সাংবাদিক ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ খাইরুলের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।
তখনই পরিবার জানতে পারে তার অবস্থানের কথা। শেষপর্যন্ত তিনিও ভারতে ফেরত এসেছেন, কিন্তু তার পরিবারের মতে, তাকে আবার তুলে নেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
সানজিমা বেগম নামে এক নারী বলেন, তার বাবা আবদুল লতিফকে ভুল পরিচয়ের কারণে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছিল। তার বাবার নাম আবদুল লতিফ, আর দাদার নাম আবদুল সুবহান।
কিন্তু ট্রাইব্যুনাল যে নোটিশ দিয়েছিল তাতে লেখা ছিল আবদুল লতিফ, পিতা শুকুর আলী— যারা তাদের কেউ নন।
তাদের পরিবার এখন শুনেছে, আবদুল লতিফ ফিরে এসেছেন, কিন্তু এখনো বাড়ি পৌঁছাননি। যদিও অনেকে বাড়ি ফিরেছেন, তাদের ভয় এখনও রয়ে গেছে যে আবারও হয়তো তুলে নেওয়া হতে পারে।
সানজিমা বলছেন, আমরা খেলনা নই। মানুষকে এভাবে ইচ্ছেমতো সরিয়ে দেওয়া যায় না।