পাকিস্তানি বহুজাতিক ব্র্যান্ডের চোখ বাংলাদেশি বাজারে

মাজহারুল ইসলাম মিচেল
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:০২ এএম

পাকিস্তানি বহুজাতিক ব্র্যান্ডের চোখ বাংলাদেশি বাজারে
বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিকে ঘিরে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে পাকিস্তানের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। ভোক্তা পণ্য, ফ্যাশন, প্রযুক্তি এবং বিশেষ করে খাদ্যপণ্য খাতে বেশ কিছু সুপরিচিত ব্র্যান্ড বাংলাদেশে প্রবেশের উদ্যোগ নিচ্ছে।
গত এক দশকে তৈরি পোশাক রপ্তানি, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এর ফলে শুধু পশ্চিমা বা পূর্ব এশীয় করপোরেশনই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক খেলোয়াড় পাকিস্তানও বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে বিবেচনা করছে।
পোশাক ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানিয়েছেন, পাকিস্তানের জনপ্রিয় পোশাক ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড খাদি, স্যাফায়ার এবং গুল আহমেদ ইতোমধ্যেই ঢাকাসহ চট্টগ্রামের বাজার নিয়ে সমীক্ষা শুরু করেছে। তরুণ জনগোষ্ঠী এবং ব্র্যান্ড সচেতন ভোক্তাদের কারণে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মতো সাফল্য বাংলাদেশেও পুনরাবৃত্তি করতে চায়।
খাদ্য ও প্রসাধনী কোম্পানি
পাকিস্তানের প্যাকেটজাত খাদ্য ও ব্যক্তিগত পরিচর্যা পণ্য প্রস্তুতকারকরা বাংলাদেশে ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। ব্যবসায়ীদের ধারণা, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) অনুযায়ী শুল্ক কাঠামো অনুকূলে থাকলে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য আনা সম্ভব হবে।
বেক পার্লার, কার্শি ইন্ডাস্ট্রিজ, আহমেদ ফুডস, লাজ্জাত ফুডস এবং দাশী ইন্টারন্যাশনালসহ অন্তত ছয়টি খাদ্য কোম্পানি বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, তাদের ব্র্যান্ড পাকিস্তানসহ আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয়। অনেক প্রতিষ্ঠানই শতাধিক দেশে রপ্তানি করছে এবং এখন তারা বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় নতুন গন্তব্য হিসেবে দেখছে।
আহমেদ ফুডসের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার তালহা রফিক ভোরের কাগজ-কে বলেন, “আমরা গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছি। কিন্তু আগের সরকার অনুমতি দেয়নি। উচ্চ কর দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েও আমরা অনুমোদন পাইনি।”
লাজ্জাত ফুডসের এক্সপোর্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শারিক ফেরোজ দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠান একসময় বাংলাদেশের বাজারে সক্রিয় ছিল, তবে আগের সরকার জোর করে কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য করে। এখন তারা আবারও প্রবেশের চেষ্টা করছে, যদি সরকার ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে।
কার্শি ইন্ডাস্ট্রিজের হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ইরফান সোহাইল বলেন, “বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীই ব্যবসার মূল আকর্ষণ। এই বাজারের বিশাল সম্ভাবনা আছে। যদি সরকার সহায়তা দেয়, পাকিস্তানি কোম্পানিগুলো শুধু পণ্য রপ্তানি নয়, বাংলাদেশেই কারখানা বা গুদাম স্থাপন করবে।”
বেক পার্লারের ডিভিশনাল হেড অব ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ওবায়েদ হাসান জানান, বেশির ভাগ কোম্পানি বাংলাদেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি ও ডিস্ট্রিবিউটরশিপ গড়ে তুলে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে চায়।
খাবারের বাইরেও আগ্রহ
শুধু খাদ্য নয়, পাকিস্তানি ব্র্যান্ডগুলো হোম ডেকর, টেক্সটাইল এবং প্রসাধনী খাতেও বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চেন ওয়ান কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মারিয়া তৌকির খান জানান, এসব খাতেও পাকিস্তানি ব্র্যান্ড বাংলাদেশের অনুকূল পরিবেশ কাজে লাগাতে চায়।
নাভিয়া কসমেটিকসের ম্যানেজিং পার্টনার রিজওয়ান আসগর রানা বলেন, “পাকিস্তানের অনেক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি বাজারের সঙ্গে যুক্ত। শেষ পর্যন্ত বাজারের যুক্তিই রাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করবে।”
ডিজিটাল ও প্রযুক্তি খাতের আগ্রহ
পোশাক ও ভোক্তা পণ্যের বাইরে পাকিস্তানি স্টার্টআপগুলো ফিনটেক ও ই-কমার্স খাতেও বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় মনে করছে। ১২ কোটি ৫০ লাখের বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং দ্রুত মোবাইল ব্যাংকিং বিস্তারের কারণে বাংলাদেশকে তারা ডিজিটাল সেবার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে।
করাচিভিত্তিক পেমেন্ট প্রতিষ্ঠান ও লজিস্টিকস স্টার্টআপগুলো ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশি অংশীদারদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের সীমান্তপার সহযোগিতা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে এবং সাপ্লাই চেইন আরও শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।
প্রতিযোগিতা ও চ্যালেঞ্জ
ঢাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, “ভোক্তারা দাম ও মান দেখে, রাজনীতি নয়। পাকিস্তানি ব্র্যান্ডগুলো যদি প্রতিযোগিতামূলক পণ্য দিতে পারে, তাহলে তাদের ক্রেতা থাকবে।” তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ভারত, চীন ও পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলিও বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। ফলে পাকিস্তানি ব্র্যান্ডগুলোকে সফল হতে হলে স্থানীয়করণ কৌশল গ্রহণ, ব্র্যান্ডিংয়ে বিনিয়োগ এবং দেশীয় ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে অংশীদারত্ব করতে হবে।
পাকিস্তানি টেক্সটাইল ব্র্যান্ড হাউস অব চামড়া-র মালিক কাউসার আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের দ্রুত নগরায়ণ এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে বাজার আরও বড় হচ্ছে। আঞ্চলিক কোম্পানিগুলোর জন্য এটি বড় সুযোগ।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশি বাজারে প্রবেশ পাকিস্তানি কোম্পানিগুলোর জন্য কেবল ব্যবসা সম্প্রসারণই নয়, বরং বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সংহতির দিকেও একটি পদক্ষেপ হতে পারে। তবে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও নীতিগত জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারলেই এই উদ্যোগ বাস্তবে রূপ নেবে।