মার্কিন হামলার ইরানি প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ০৬:২৬ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র গতকাল রবিবার দিবাগত রাতে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর থেকে পুরো বিশ্ব ইরানের প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় আছে। ওই দিন ইরানে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের সঙ্গে যোগ দিয়ে হামলা চালিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ভূগর্ভস্থ ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাংকার–বিধ্বংসী বোমা ফেলার ১ দিন পর ইরান আত্মরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা তেহরানকে পিছু হটার আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
গতকাল নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে সরকার পরিবর্তনের ধারণা তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, ‘সরকার পরিবর্তন’ কথাটি রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়। কিন্তু বর্তমান সরকার যদি ইরানকে আবার মহান করতে না পারে, তাহলে কেন সরকার পরিবর্তন হবে না?’
ইরান ও ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
এক ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র বলেন, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান পশ্চিম ইরানের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। এর আগে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। এতে তেল আবিবে বহু মানুষ আহত হয় এবং বিভিন্ন ভবন লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ’সম্পর্কে সতর্ক করেছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য সাইবার হামলা বা লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক স্থাপনার ওপর বিশেষ নজর দিয়ে টহল জোরদার করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আকাশপথ বন্ধ থাকায় সম্ভাব্য বিক্ষোভ ও ভ্রমণে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে এবং তাঁদের ‘অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের’ আহ্বান জানিয়েছে।
তেহরান এখনো মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা বা বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করাসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কোনো হুমকি বাস্তবায়ন করেনি। তবে তারা হয়তো বেশি দিন চুপ থাকবে না।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বক্তৃতায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, তাঁর দেশ সব ধরনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করবে। তিনি বলেন, ইরান প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত কূটনীতিতে ফেরার প্রশ্নই আসে না। যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করেছে যে তারা আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করে না। তারা শুধু হুমকি-ধমকি আর বলপ্রয়োগের ভাষা বোঝে।
টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে ‘চমকপ্রদ সামরিক সাফল্য’ বলে অভিহিত করেন এবং দাবি করেন যে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো ‘একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে’।
বাণিজ্যিক কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি ইঙ্গিত দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের ভূগর্ভস্থ ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে থাকা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সেন্ট্রিফিউজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর পারমাণবিক স্থাপনাটির বাইরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
সংস্থাটির মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি সিএনএনকে বলেন, ভূগর্ভে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
ইরানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ফর্দোতে থাকা উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বেশির ভাগই হামলার আগেই অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
রয়টার্স তাৎক্ষণিকভাবে এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ম্যাক্সার টেকনোলজিসের স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার স্থাপনাটির প্রবেশপথের বাইরে গাড়ির দীর্ঘ সারি দাঁড়িয়ে ছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতিতে তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় জুয়া খেলতে যাওয়ার আগে কখনো কূটনীতির মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রস্তাব দিয়েছেন, আবার কখনো নিজেই এ যুদ্ধে জড়ানোর হুমকি দিয়েছেন। তিনি ইরানকে প্রতিশোধ না নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ইরানের সরকারকে ‘এখন শান্তি স্থাপন করতে হবে’ অথবা ‘ভবিষ্যতে হামলা আরও বড় ও সহজ হবে’।
পশ্চিমাদের আঘাত করতে ইরানের যে হুমকিকে সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করা হয় তা হলো, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি। আর এ ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে গেছে দেশটি। তেহরানের পার্লামেন্ট প্রণালিটি বন্ধ করার একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের প্রায় এক–চতুর্থাংশ জ্বালানি তেল পরিবহন হয়। প্রণালিটি ইরান, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিস্তৃত।
ইরানের প্রেস টিভি জানায়, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে হলে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির মনোনীত এক কর্মকর্তার মাধ্যমে এ পরিষদ পরিচালিত হয়।
হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে উপসাগরের তেলপ্রবাহ বিঘ্নিত করার চেষ্টায় বিশ্ব বাজারে তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠতে পারে। বৈশ্বিক অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। উপসাগরে মোতায়েন করা বিশাল মার্কিন পঞ্চম নৌবহরের সঙ্গে সংঘাত ডেকে আনতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সিবিএসের ‘ফেস দ্য নেশন’অনুষ্ঠানে বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে আর কোনো সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা নেই, যদি না তারা আবার ঝামেলা করে।
গতকাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে আলোচনায় বসে। যেখানে রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তান প্রস্তাব দেয় যে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ যেন মধ্যপ্রাচ্যে অবিলম্বে এবং নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবর্ষণ এই অঞ্চলে বিপজ্জনক মোড় নিয়ে এসেছে। তিনি যুদ্ধ বন্ধ করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানান।