গ্রাস করছে জীবনী শক্তি
দানবের নাম ‘প্লাস্টিক’

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ০১:০০ পিএম

প্লাস্টিক
পরিবেশ দূষণ, প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে হাকডাকের কমতি নেই। কিন্তু বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। উল্টে জীবন হয়ে উঠেছে প্লাস্টিকময়।
বাজার সদাই পরিবহন থেকে শুরু করে খাবার রাখা, নিত্য ব্যবহার্য্য প্রায় সব পণ্যই প্লাস্টিকের। এসব প্লাস্টিক পণ্য ধীরে ধীরে মানবজীবনকে গ্রাস করছে।
ডায়বেটিস, মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ জটিল সব রোগের প্রকোপ বাড়ছে। শুধু তাই নয়, জীববৈচিত্র্যও পড়েছে হুমকিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রের তিমি থেকে শুরু করে ছোট ক্ষুদ্রকায় প্রাণীতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেছে। এমন কোনো বস্তু নেই যেখানে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের রক্তেও মিশে গেছে।
শরীরের কিডনি, হার্ট, মানুষের ব্রেইন, ডিম্বাণু-শুক্রাণুতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিথিন ও মাইক্রোপ্লাস্টিক যে কতটা ক্ষতিকর, তা জনগণকে অনুধাবন করতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে মানুষের মনোজগতে। তবেই এই দানবের হাত থেকে মুক্তি মিলবে।
প্লাস্টিক নিয়ে সম্প্রতি নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি একটি গবেষণা করেছে। মার্চ মাসে ‘এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল’ জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মশলা, খাবার রাখার কৌটো, জলের বোতলে যে পিভিসি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় এবং রেস্তরাঁর খাবার প্যাক করার কৌটো বা ট্রেতে যে ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, তাতে হাজারো ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে।
এই রাসায়নিক মস্তিষ্কের অ্যাডিনোসিন-১ রিসেপ্টরকে সক্রিয় করে দেয়। তাতে কোষের সঙ্কেতের ক্ষতি হয় এবং দেহ-ঘড়ির ছন্দ নষ্ট করে। মানুষের দেহ অজস্র কোষের সমাহার। পরিবেশ পরিস্থিতির সাপেক্ষে শরীরে প্রতি মুহূর্তে যে বদল ঘটে, তা সম্ভব হয় কোষের সঙ্কেতের মাধ্যমে।
এ ছাড়া রোগ হলে শরীর কী ভাবে তার মোকাবিলা করবে, শরীরের পেশি, তন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা কী ভাবে মেরামত হবে, স্নায়ুতন্ত্রের যে যোগাযোগ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জরুরি, সে সবই চালিত হয় কোষের সঙ্কেতের মাধ্যমে আর প্লাস্টিকজাত রাসায়নিক সেই প্রক্রিয়াকেই বিপর্যস্ত করে।
অপরদিকে, প্লাস্টিকের রাসায়নিকের মাধ্যমে অসময়ে সক্রিয় হওয়া অ্যাডিনোসিন দেহ-ঘড়ির রুটিন থেকে ১৭ মিনিট নষ্ট করে দেয়। যার ফলে ক্রমানুসারে নষ্ট হতে থাকে অন্যান্য কাজের জন্য নির্ধারিত সময়। নষ্ট হয় ঘুম। পাশাপাশি, স্থূলত্ব, স্মৃতিভ্রম বা ডিমেনশিয়া, হার্টের রোগ-সহ নানা ধরনের রোগ ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় শরীরে।
২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে উৎপাদিত সামুদ্রিক লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়েছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) গবেষকরা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ১২টি লবণ উৎপাদনকারী স্থান থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা লবণের প্রতি কেজিতে ৫৬০ থেকে ১ হাজার ২৫৩টি প্লাস্টিক কণা শনাক্ত করেছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন সুপারমার্কেট থেকে সংগৃহিত চিনি ও টি-ব্যাগ নিয়ে দুটি গবেষণা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষক। ‘ইজ দেয়ার টি কমপ্লিমেন্টেড উইথ দি অ্যাপেইলিং ফ্লেভার অব মাইক্রোপ্লাস্টিক?
এ পায়োনিয়ারিং স্টাডি অন প্লাস্টিক পলিউশন ইন কমার্শিয়ালি এভেইলেবল টি-ব্যাগস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই গবেষণায় সংগৃহিত পাঁচটি ব্র্যান্ড ও দুটি নন ব্র্যান্ডের চিনি পরীক্ষায়, প্রতি কেজিতে গড়ে ৩৪৩ দশমিক ৭টি প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি মিলেছে।
নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত পাঁচটি ব্র্যান্ডের টি-ব্যাগেও প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে। ২০২২ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টে’-এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। বাজারে পাওয়া যায় এমন দেশি মাছের ওপর গবেষণা করে জানা যায়, ১৫ প্রজাতির মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি এণ্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স’র অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন জানান, প্লাস্টিকের ৫ ধরনের সুবিধা ও ৫ ধরনের বিপজ্জনক দিক রয়েছে।
১৯৫০ সালে যেখানে সারাবিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন হতো ২ মিলিয়ন টন। সেখানে ২০২৩ সালে তা দাঁড়ায় ৪১৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ এই সময়ে ২৩০ গুণ বেড়েছে। লাতিন আমেরিকায় ৫ শতাংশ, মিডেল ইস্ট ও আফ্রিকায় ৯ শতাংশ, ইউরোপ ১৪ শতাংশ, নর্থ আমেরিকা ১৭ শতাংশ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ৫৫ শতাংশ প্লাস্টিক উৎপাদন হয়।
এর মধ্যে ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে প্যাকেজিং খাতে ৪০ শতাংশ, কনস্ট্রাকশনে ২০ শতাংশ, অটোমোটিভে ৮ শতাংশ, ইলেকট্রনিকসে ৫ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছে। বছরে বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন হয় ৪১৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন। আর খরচ হয় ৩৬০ মিলিয়ন টন। সেই হিসেবে প্রতিজনে দিনে শূণ্য দশমিক ২ থেকে শূণ্য দশমিক ৮ কেজি পর্যন্ত খরচ করে থাকে।
তিনি আরো জানান, বাংলাদেশে মোট প্লাস্টিকের মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইকেল হয়। আর ১৯ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর ৫০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হয়। ২২ শতাংশ পরিবেশে মিশে যায়। যা নানাভাবে পরিবেশ, প্রাণীকূল, মানবজীবনে প্রভাব ফেলে। একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ পঁচতে ২০ বৎসর, একটি কাপ ৫০ বৎসর, প্লাস্টিকের স্ট্র দু’শ বছর, বোতল সাড়ে চারশো বছর, ফিশিং লাইন ৫’শ বছর লাগে। এবং সৃষ্ট মাইক্রোপ্লাস্টিক আজীবন টিকে থাকে। এগুলো বায়োডাইভারসিটি নষ্ট করে।
একইসঙ্গে খাদ্য দূষণ, কেমিক্যাল ছড়ানোসহ নানাভাবে ক্ষতি করে। পৃথিবীর বড় ১ হাজারটি নদী সাগরের ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক জমা হওয়ার জন্য দায়ী। বছরে ১৯-২৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ইকোসিস্টেমে মিশে যাচ্ছে।
গত এক দশক ধরে পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করছে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন ইকো। এই কর্মসূচির মাধ্যমে সংগঠনটি দেশের ৬৪টি জেলায় প্লাস্টিক দূষণ বিরোধী সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে চায়।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্লাস্টিক দূষণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ২০২৫ সালে এসেও এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। তাই শুধু আইন নয়, প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা।
এদিকে দায়িত্ব নেয়ার পর প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে বেশ জোরে সোরেই মাঠে নেমেছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পলিথিন নিষিদ্ধে মোবাইল কোট পরিচালনা, জরিমানা আদায়সহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। কিন্তু অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় পলিথিন শপিং ব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক) বন্ধে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ১৭টি পণ্যকে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ৩টি পণ্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সুপার শপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে এবং অন্যান্য মার্কেটেও তা বন্ধের কার্যক্রম চলছে।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, প্লাস্টিক দূষণ এখন মানবদেহেও প্রবেশ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিডনি, লিভার এমনকি মস্তিষ্কেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত সুপারশপে সফল হলেও অন্য জায়গায় আরও কাজ করতে হবে। কারণ পলিথিনের নেতিবাচক দিকগুলো মানুষ জানে না। সেক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগসহ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধ করার চেষ্টা করব। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার থেকে মানুষকে সরিয়ে আনতে।
বাংলাদেশের পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক প্রাণঘাতি। আমরা দীর্ঘদিন থেকে এটা নিয়ে কথা বলছি। কখনো বিষয়টিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি।