নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন
নির্বাচন নিয়ে চাপের মুখে পদত্যাগের হুমকি ড. ইউনূসের

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ১২:২৭ পিএম

ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : সংগৃহীত
গত আগস্টে যখন ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন একটি আদর্শবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান স্বৈরশাসক সরকারকে উৎখাত করা হয়, তখন কোটি কোটি বাংলাদেশি গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের সম্ভাবনায় উল্লসিত হন। তবে প্রায় নয় মাস পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবার সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তারা অবিলম্বে নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে চেয়েছিলেন।
এখন, এই সরকারের প্রধান শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস হুমকি দিয়েছেন- যদি তাকে ধীরে ধীরে দেশের নির্বাচন প্রস্তুত করার কাজ করতে না দেয়া হয়, তবে তিনি পদত্যাগ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত এই নেতাকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার সেরা সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। রাস্তায় রক্তের দাগ লেগে থাকতেই তাকে অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে তার সহকর্মীরা বলছেন, দেশের প্রধান বিরাজমান রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে একরকম ঐক্য তার নীতিমালার সমালোচনা করছে এবং নির্বাচন পরিকল্পনায় তার ধীর গতিতে অসন্তুষ্ট। এই কারণে তিনি নিজের ক্ষমতাবলে কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন না বলে হতাশ।
বৃহস্পতিবার ড. ইউনূস স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, যদি তিনি রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন না পান, তাহলে পদত্যাগ করবেন। তার সরকারে একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ড. ইউনূস ইতোমধ্যে পদত্যাগের একটি ভাষণের খসড়াও করেছিলেন। তবে অন্য উপদেষ্টারা তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, তার পদত্যাগ বাংলাদেশকে আরো অস্থির করে তুলবে। ওই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের আহ্বানে ইউনূস বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের লাগাতার সমালোচনায় তিনি ক্লান্ত।
শেখ হাসিনার পুরনো বিরোধীরা কোনো নির্বাচন হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে, ততই বেশি লাভবান হবেন তারা। আওয়ামী লীগ কলঙ্কিত হয়ে পড়ার পর এবং সম্প্রতি দলটি পুরোপুরি নিষিদ্ধ হওয়ার পর, বাংলাদেশ কার্যত অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন অবস্থায় আটকে পড়েছে। এছাড়াও দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং তা পুনরুদ্ধারের জন্য খাপছাড়া পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। ড. ইউনূস বর্তমানে সেনাবাহিনী ও বিএনপি- উভয় পক্ষের চাপের মধ্যে রয়েছেন। কারণ, তার নিজের রাজনৈতিক কোনো ভিত্তি নেই।
অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবাশার হাসান বলেন, ড. ইউনূস ভালো ব্যাংকার হতে পারেন, ভালো প্রতিষ্ঠান চালাতেও পারেন। কিন্তু তিনি একজন দৃঢ় ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের নেতা নন। এটা দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। তার মতে, ড. ইউনূস অনেক সময় নিজের উপদেষ্টাদের দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত হন।
আরো পড়ুন : অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠন করতে হলে যেসব আইনি প্রশ্ন সামনে আসবে
ড. ইউনূস এখন অনুভব করছেন যে, যারা তার সহায়ক হওয়ার কথা ছিল, তারাই তাকে একঘরে করে দিচ্ছেন। তার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী জানান, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যখন বুধবার ঘোষণা দেন যে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত, তখন ইউনূস যেন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ড. ইউনূস আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের জুন নাগাদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। কিন্তু তিনি কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি দেননি। তিনি তার উপদেষ্টা পরিষদকে জানিয়েছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনুকূল নয়।
গত নভেম্বরের জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটি আর থামবে না। কিন্তু আমাদের পথে বহু কাজ সম্পন্ন করতে হবে।’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বলছে, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আগে একটি গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর, এই দলটি এখন ক্ষমতা লাভের সুযোগ নিতে চাইছে। প্রথমদিকে বিএনপি ড. ইউনূসের সরকারকে সমর্থন দিলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একাধিক নীতিগত মতবিরোধের কারণে তারা আর সহযোগিতা করছে না।
উদাহরণস্বরূপ, ইউনূস এবং তার কর্মকর্তারা চান দেশের সবচেয়ে বড় বন্দর চট্টগ্রাম বেসরকারিকরণ করতে, মিয়ানমারের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে একটি সাহায্য করিডোর খুলতে এবং বাংলাদেশের মূল কর কর্তৃপক্ষকে (এনবিআর) ভেঙে ভাগ করতে।
দেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাকে স্থিতিশীল করার কাজ ৮৪ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদের জন্য অত্যন্ত কঠিন প্রায় অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ এবং অপরটি দ্রুত নির্বাচন দাবি করায়, ড. ইউনূস সময় নিতে চাইছেন বলে ধারণা। এমনকি এটা তার প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্লেষকদেরও বিরক্ত করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবাশার হাসান বলেন, এই নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত- এতে কোনো বাধা নেই। সবকিছু সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পেছনে থাকা ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা তার সমর্থকদের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা চায় না, হাসিনার পুরনো বিরোধীরা- বিএনপি - এসে তার জায়গা দখল করুক। এখনো তাদের আস্থা ড. ইউনূসের ওপরই। ফেব্রুয়ারিতে ড. ইউনূসের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ‘ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যার লক্ষ্য ছাত্রদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা। নাহিদ ইসলাম জানান, তিনি ড. ইউনূসকে পদত্যাগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার তারা কথা বলেন এবং ইউনূস তাকে জানান, যেসব প্রতিশ্রুতি তাকে দায়িত্ব নেয়ার সময় দেয়া হয়েছিল, তা ভঙ্গ করা হয়েছে। নাহিদ বলেন, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সৃষ্টি করা অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে সরকারকে চাপ দিয়ে চলার কারণে তিনি মনে করছেন, আর কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।