পরিবেশ রক্ষায় সাহসী সাংবাদিক রিনা আকতার তুলির অনন্য ভূমিকা
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ০৪:৩৪ এএম

সাহসী নারী সাংবাদিক রিনা আকতার তুলি। ছবি: সংগৃহীত
হুমকি, পেশিশক্তি আর রাজনৈতিক ছত্রছায়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এক অদম্য নারীর দীর্ঘ এক দশকের লড়াইয়ের অবশেষে সফল পরিসমাপ্তি ঘটল। সাংবাদিক রিনা আকতার তুলির আপসহীন কলমযুদ্ধের ফলে পাবনার বেড়া উপজেলার আমিনপুর থানার সিন্দুরী গ্রামে ফসলি জমির বুক চিরে গড়ে ওঠা ৫টি অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
গত ৩০ এপ্রিল দিনব্যাপী পরিচালিত এক সাঁড়াশি অভিযানে এই ঘাতক ইটভাটাগুলো উচ্ছেদ করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের নিয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী এই অভিযান পরিচালনা করে। এই উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে শুধু ৫০ বিঘা উর্বর ফসলি জমিই দখলমুক্ত হয়নি, বিষাক্ত ধোঁয়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছে এলাকার বিপন্ন পরিবেশ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন সিন্দুরী ও আশপাশের গ্রামের হাজারো মানুষ।
যেভাবে শুরু এক নারীর অদম্য লড়াই
এই সাফল্যের পেছনের মূল কারিগর সাহসী নারী সাংবাদিক রিনা আকতার তুলি। নিজের গ্রাম ও কৃষিজমিকে বাঁচাতে তিনি একাই যেন হয়ে উঠেছিলেন এক পরিবেশযোদ্ধা। সংগ্রামের শুরু প্রায় এক দশক আগে, ২০১৬ সালে। সে সময় এলাকার প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ভূমিদস্যু রাজ্জাক মাস্টার ও তার দুই ছেলে আব্দুল আলিম ও আলাউদ্দিন সাংবাদিক তুলির নিজের ৫৯ শতাংশ জমিতেই জোরপূর্বক ‘মাস্টার ব্রিকস’ নামে ইটভাটার চিমনি বসানোর কাজ শুরু করে।
শুরুতেই রুখে দাঁড়ান তুলি। তিনি বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানালে নামমাত্র একটি নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই নোটিশ উপেক্ষা করে ভূমিদস্যুরা পেশিশক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভাটার নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে। এর দেখাদেখি কোনো প্রকার অনুমোদন ছাড়াই একে একে গড়ে ওঠে একতা, সততা ও সততা প্লাসসহ আরও চারটি অবৈধ ইটভাটা।
সাংবাদিক রিনা আক্তার তুলি বলেন, সেদিন পণ করেছিলাম, যেকোনো মূল্যে গ্রামের পরিবেশ ও কৃষিজমি রক্ষা করব। এই দীর্ঘ লড়াইয়ে আমাকে ও আমার পরিবারকে অসংখ্যবার হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে, নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমি দমে যাইনি। আমি বিশ্বাস করতাম, সত্যের জয় হবেই।
পরিবেশ বিপর্যয় ও গণমাধ্যমের ভূমিকা
এই অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিষাক্ত ধোঁয়ায় সিন্দুরীসহ আশপাশের চার-পাঁচটি গ্রামের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে থাকে; আম, কলা ও লিচুর মুকুল কালো হয়ে ঝরে যেত। এলাকার শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরে সাংবাদিক তুলি গত ১০ বছর ধরে দৈনিক যুগান্তর, বাংলানিউজ, খবরের কাগজে একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এছাড়া তার সহযোগিতায় প্রথম আলোসহ দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলোও লাগাতার সংবাদ প্রকাশ করে। তুলির ক্ষুরধার লেখনী ও ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের ফলে বিষয়টি অবশেষে প্রশাসনের উচ্চ মহলের নজরে আসে।
হাইকোর্টের নির্দেশ ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও পরিবেশবাদীদের আবেদনের ভিত্তিতে বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ায়। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সারাদেশের সকল অবৈধ ইটভাটা চার সপ্তাহের মধ্যে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ প্রদান করেন।
এই নির্দেশের সূত্র ধরেই গত ৩০ এপ্রিল পাবনা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় পরিবেশ অধিদপ্তর সিন্দুরী গ্রামে অভিযান চালায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা অভিযানে অবৈধ ইটভাটাগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়।
উচ্ছেদ অভিযান শেষে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সকল স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখব। সাংবাদিক রিনা আকতার তুলির মতো সচেতন নাগরিকরা এগিয়ে এলে আমাদের কাজ আরও সহজ হয়।
বর্তমানে সিন্দুরী গ্রামের বাতাসে আর বিষাক্ত ধোঁয়া নেই। দখলমুক্ত ৫০ বিঘা জমিতে কৃষকরা আবার নতুন করে চাষাবাদের স্বপ্ন দেখছেন। স্থানীয়রা বলছেন, রিনা আকতার তুলির এই সংগ্রাম শুধু একটি গ্রামের গল্প নয়, এটি পরিবেশ রক্ষায় একজন অদম্য নারীর বিজয়ের প্রতীক, যা ভবিষ্যতেও অনেককে অনুপ্রেরণা জোগাবে।