কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান, স্বপ্ন নতুন বাংলাদেশ

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১০:২৪ এএম

কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এক ছাত্র-আন্দোলন পরিণত হয় তীব্র গণ-অভ্যুত্থানে। ছবি : সংগৃহীত
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এক ছাত্র-আন্দোলন পরিণত হয় তীব্র গণ-অভ্যুত্থানে। দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
শুরুতে যে আন্দোলন ছিল শুধুই কোটা সংস্কারের দাবি, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দমন-পীড়ন, শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলি ও রক্তপাত এই আন্দোলনকে পরিণত করে বিস্ফোরিত জনরোষে, যা ভেঙে দেয় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি।
কোটা বাতিল, আদালতের রায় ও উত্তাল রাজপথ
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর তৎকালীন সরকার নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি করে। বাতিল হয় মুক্তিযোদ্ধা (৩০%), নারী (১০%), জেলা (১০%), ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (৫%) ও প্রতিবন্ধী (১%) কোটাসহ বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি।
তবে এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। ২০২১ সালে দায়ের করা রিটের প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা বহালের নির্দেশ দেয়। এরপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। হাইকোর্টের রায় কার্যকরের প্রতিবাদে তারা ফের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে।
বাংলা ব্লকেড: রাজপথে ছাত্র-জনতা
৬ জুলাই ঈদের ছুটির পর আন্দোলন নতুন মাত্রায় রূপ নেয়। ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির আওতায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন।
আরো পড়ুন : প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনালাপ
১১ জুলাই হাইকোর্টের রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনি এবং অন্যান্য কোটার (নারী, সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী) পুনর্বহাল নির্দেশ আসে। তিন মাসের মধ্যে কোটা বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। তবে রায়ে বলা হয়, প্রয়োজনে কোটার অনুপাত পরিবর্তন করা যাবে এবং কোটা পূরণ না হলে মেধা তালিকা থেকে পদ পূরণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে আগুনে ঘি: 'তুমি কে, আমি কে, রাজাকার-রাজাকার'
১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, তো রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?" এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ১৫ জুলাই মধ্যরাতে আন্দোলনকারীরা নতুন স্লোগান তোলে। তারা “তুমি কে, আমি কে, রাজাকার-রাজাকার” স্লোগানে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। স্লোগানটি দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, আন্দোলনে যোগ হয় রাজনৈতিক প্রতিরোধের নতুন মাত্রা।
প্রথম শহীদ আবু সাঈদ: রক্তে লেখা ইতিহাস
১৬ জুলাই, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তিনি ছিলেন ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের ছাত্র ও আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তাঁর মৃত্যু ছিল এই আন্দোলনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। এরপরই শহীদের রক্তে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে রাজপথ। ঢাকা থেকে দিনাজপুর, সিলেট থেকে বরিশাল—সবখানেই প্রতিরোধ জ্বলে ওঠে।
এক দফা ঘোষণা: শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি
৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন- শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগই এখন একমাত্র দাবি। ততদিনে আন্দোলনে নিহতদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আন্দোলন আরো সংগঠিত, আরো একমুখী হয়ে ওঠে।
লং মার্চ, গণজোয়ার এবং শেখ হাসিনার দেশত্যাগ
৬ আগস্ট 'লং মার্চ টু ঢাকা'র ঘোষণা আসে। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে একদিন আগেই অর্থাৎ ৫ আগস্ট লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি দেয়া হয়। সেদিন সকাল থেকেই সারাদেশের ছাত্র-জনতা, সাধারণ মানুষ ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। রাস্তায় নেমে আসে লাখো মানুষ, ঢাকার প্রবেশপথে সংঘর্ষ, ব্যারিকেড, কিন্তু জনস্রোত থামে না।
বিক্ষুদ্ধ জনতার লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের দিকে। প্রচণ্ড গণরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন। ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন তিনি।
স্বপ্ন এক নতুন বাংলাদেশের
এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছাত্র সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ দেশের জন্য ঘোষণা করে নতুন রাজনৈতিক পথরেখা। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয় প্রশাসনের। দেশজুড়ে শুরু হয় “নতুন বাংলাদেশ” গঠনের স্বপ্ন।
প্রথমে ছিল শুধুই একটি প্রশাসনিক দাবির আন্দোলন—কোটা সংস্কার। শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠে সামাজিক ন্যায়ের সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের আন্দোলন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৫ সালের জুলাই মাস হয়ে থাকবে গণআন্দোলনের একটি স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে।