গঙ্গা পানি চুক্তির নবায়ন নিয়ে নানামুখী আলোচনা

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য, (ঢাকা) ও ঋষি চক্রবর্তী, (কলকাতা)
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৪১ পিএম

গঙ্গা পানি চুক্তির নবায়ন নিয়ে নানামুখী আলোচনা
আর বছরখানেকের মধ্যে চলমান গঙ্গা-পদ্মা পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে সই হওয়া ৩০ বছর মেয়াদি এই চুক্তি শেষ হওয়ার পর এর ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, এই চুক্তির মূল বিষয় হল শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে মে মাস) ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানিপ্রবাহের ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগ করে নেয়া। আগামী বছরের ডিসেম্বরে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভারত বর্তমানে এই চুক্তিতে কিছু পরিবর্তন আনতে চাইছে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে। ভারত চাইছে, শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহার করতে এবং নতুন ফর্মুলায় পানি ভাগাভাগি করার বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। অন্যদিকে বাংলাদেশ চাইছে, চুক্তিটি এমনভাবে নবায়ন করা হোক যাতে তাদের পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা যায় এবং কোনো পক্ষই একতরফাভাবে পানি ব্যবহার করতে না পারে।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে টালবাহানার কিছু নেই। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধানের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। এখানে টালবাহানার কিছু নেই। আর যদি এমন কিছু যদি থাকেও টালবাহানা মেনে নেয়া হবে না। তিনি বলেন, ভারত থেকে আমরা এ ব্যাপারে গত ১৫-২০ এমনকি ৩০ বছরেও পজিটিভ কিছু পাইনি। বহু আগে একবার পজিটিভ মতামত এসেছিল। তখন আমরা গ্রহণ করিনি। এ পর্যায়ে আছে এখন। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি। কতটুকু সফল হই সেটা দেখা যাবে।
এদিকে ভারতীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শর্ত এবং ইচ্ছেতেই চুক্তি নবায়নের এগিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এমন কথার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছে, গঙ্গা-পদ্মা পানি চুক্তির নবায়নের ক্ষেত্রে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির মত গ্যড়াকলে যাতে পড়তে না হয় সেজন্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
সূত্রের খবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত ভাগ করে নেয়া রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই এই চুক্তি পুনর্নবীকরণের ভবিষ্যৎ মডেল তৈরি হবে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জায়সওয়াল বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে ৫৪টি নদী। তার মধ্যে রয়েছে গঙ্গাও। এই নদী চুক্তির ব্যাপারে আমরা যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে সমন্বয় করছি। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আমাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনা চলছে, কী ধরনের পদক্ষেপ করা হবে তা তৈরি করতে। যে পরিবেশে উভয়পক্ষের স্বার্থ রক্ষিত হয়, সেই পরিবেশে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্ত বিষয়টি নিয়েই আলোচনায় প্রস্তুত।
গত মার্চে ভারত-বাংলাদেশ নদী কমিশনের প্রতিনিধিরা কলকাতা গিয়ে বৈঠক করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের সঙ্গে। তারা যৌথ ভাবে ফারাক্কা ব্যারেজের পরিদর্শনও করেছিলেন। ফারাক্কা ব্যারাজ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নদীর জলবন্টনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গঙ্গা থেকে নির্ধারিত পরিমাণ জল কী ভাবে পদ্মায় প্রবাহিত হচ্ছে, তা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করছিলেন দুই দেশের বিশেষজ্ঞেরা। তবে মার্চের পর বিষয়টির অগ্রগতি হয়নি। সূত্রের খবর, কলকাতা বন্দরে জল কমে যাওয়া নিয়ে রাজ্যের উদ্বেগ রয়েছে। নতুন ভাবে ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গার চুক্তির যে পুনর্নবীকরণ করা হবে, তাতে এই বিষয়টিকে মাথায় রাখতে কেন্দ্রকে অনুরোধ করেছে রাজ্য। এই ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কেন্দ্র সমন্বয়ের মাধ্যমেই এগোচ্ছে বলে জানাচ্ছে দিল্লি।
এই চুক্তি নিয়ে সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রী চন্দ্রকান্ত আর পাটিল বলেন, বিষয়টি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে যা ঠিক হবে, আমরা সে ভাবেই কাজ করব। মন্ত্রণালয় সূত্রের বক্তব্য, ১৯৯৬-এ বাংলাদেশের সঙ্গে কেন্দ্রের এইচ ডি দেবেগৌড়ার যুক্তফ্রন্ট সরকার ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার জল-বণ্টন চুক্তি করেছিল। তখন ঢাকায় শেখ হাসিনারই সরকার ছিল। সেই চুক্তির মেয়াদ ২০২৬-এ শেষ হচ্ছে। তার আগেই চুক্তির পুনর্নবীকরণ করতে হবে। ১৯৯৬-এ পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতি বসুর সরকার গঙ্গার জল-বণ্টন চুক্তিতে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ইতিমধ্যেই দিল্লিকে বার্তা দিয়েছে, রাজ্যের সঙ্গে কথা বলেই কেন্দ্রকে এগোতে হবে।
পাশাপাশি তিস্তা চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন ঠিক নেই। কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশে নেই। ফলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কবে কী হবে, তা বলা মুশকিল। পরিস্থিতি ঠিক হলে এ বিষয়ে এগোনোর চেষ্টা হবে। গত বছর শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে তিস্তার একটি জলাধার তৈরি নিয়ে যৌথ সমীক্ষার বিষয়ে কথা হয়েছিল। তার পরেই ঢাকায় শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।