নিউইয়র্ক সফর
ড. ইউনূসের ম্যারাথন বৈঠকে কী বার্তা পাচ্ছে বাংলাদেশ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪১ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০৪ জন সফরসঙ্গী নিয়ে জাতিসংঘের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। গত তিন দিনে তিনি বিভিন্ন সংস্থার প্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। কিন্তু এসব বৈঠক থেকে বাংলাদেশ কী বার্তা পাচ্ছে, তা নিয়ে কৌতুহল বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সমালোচকরা নানা কথা বললেও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে অংশ নিয়ে নিউইয়র্কে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সিরিজ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, বৈশ্বিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নিচ্ছেন তিনি। নিউইয়র্কে বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে একটি সেমিনারে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা।
এর আগে তিনি কসভোর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গত বুধবার দিনভর পাকিস্তান, ইতালি, ফিনল্যান্ড ও কসোভোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। এসব বৈঠকে জুলাই সনদে সাক্ষর, সাংবিধানিক সংস্কার, আসন্ন নির্বাচন, নিরাপদ অভিবাসন, রোহিঙ্গা সংকট ও বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তার আগে নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আয়োজনে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন ড. ইউনূস। সেখানে তিনি ট্রাম্পকে তার সুবিধামতো সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, নিউইয়র্ক স্থানীয় সময় গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা চারটি দেশের সরকার প্রধান, কয়েক মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। বৈঠকে সেসব দেশের সরকার প্রধানদের প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো শিগগিরই সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মূল বিষয়সমূহ নিয়ে একটি জুলাই সনদ সই করবে। এ সংস্কারের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে আরেকজন স্বৈরশাসকের উত্থান রোধ করা। ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থবহ রাজনৈতিক রূপান্তরের পথে অগ্রসর হবে বলেও তাদের জানান এই নোবেলজয়ী।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, চার বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানোর বিষয়েও নেতারা একমত হয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলো শিগগিরই ‘জুলাই সনদ’ সই করবে: ড. ইউনূস
গত বুধবার সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে সাইডলাইনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন ও সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। শেহবাজ শরিফ সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যাপরিস্থিতির কথা উল্লেখ করলে প্রধান উপদেষ্টা গভীর শোক ও সমবেদনা জানান।
প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বৈঠকের বরাত দিয়ে জানান, দুই নেতা নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ, পাকিস্তানের সা¤প্রতিক ভয়াবহ বন্যা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়গুলো।
বৈঠকে ড. ইউনূস জানান, বাংলাদেশ আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পথে রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন-১১টি জাতীয় কমিশনের প্রস্তাবিত বড় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার বাংলাদেশে অর্থবহ রাজনৈতিক রূপান্তরের পথ সুগম করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায় চলছে এবং দলগুলো শিগগির সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মূল বিষয়সমূহ নিয়ে একটি ‘জুলাই সনদ’ সই করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের বিকল্প পথ নিয়েও দুই নেতা আলোচনা করেন। বৈঠকে শেহবাজ শরিফ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ড. ইউনূসকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান।
ইতালি-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম গঠনে মেলোনির প্রস্তাবে সমর্থন
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বুধবার নিউইয়র্কের একটি হোটেলে ড. ইউনূস ও জর্জিয়া মেলোনির দ্বিপাক্ষীয় এই বৈঠকে বিজনেস ফোরাম গঠন, বিনিয়োগ ও নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে ইতালির প্রধানমন্ত্রী ইতালি-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম গঠনের প্রস্তাব দেন; যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে ইতালিয়ান বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করা।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান এবং বলেন, দুই দেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বিস্তারের বড় সম্ভাবনা রয়ে গেছে। উভয় নেতা বৈঠকে বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, অভিবাসন চ্যালেঞ্জ, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং আগামী ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মেলোনির বাংলাদেশে সম্ভাব্য সফর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। অভিবাসন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মেলোনি ইতালির পক্ষ থেকে ঢাকার সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, যাতে দুই দেশের জন্য নিরাপদ অভিবাসনের পথ নিশ্চিত করা যায়।
তিনি মানবপাচারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করেন, যা ভূমধ্যসাগরে শত শত মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস জানান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যেই মানবপাচারের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ এবং নিরাপদ অভিবাসনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ কার্যকর করেছে।
তিনি বলেন, মানবপাচার রোধে আরো সমন্বিত আন্তর্জাতিক উদ্যোগের প্রয়োজন। ইতালির প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূসের গত ১৪ মাসের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, ইতালি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম দেশ যারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সমর্থন জানাবে। দুই নেতা রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও গঠনমূলক আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানান।
সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে কাজ করছি, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টকে ড. ইউনূস
সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা ও আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে তার সরকার-এমন তথ্য ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব্বকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় গত বুধবার সংস্থাটির সদর দপ্তরে উভয়ের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা শেখ হাসিনা ও সহযোগীদের বিচার প্রসঙ্গেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে চলমান প্রক্রিয়ার কথা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা বাংলাদেশকে সার্ক ও আসিয়ানের মধ্যে একটি প্রধান সেতুবন্ধন হিসেবে দেখতে চাই। আসিয়ানের সঙ্গে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনারশিপের জন্য আমাদের আবেদন পূর্ণ সদস্যপদের দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ সময়ে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশ নীতি সম্পর্কে জানতে চান। বৈঠকে দুই নেতা বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, জাতিসংঘ সংস্কার, রোহিঙ্গা সংকট, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, আসিয়ান সদস্যপদ প্রক্রিয়া, শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার এবং নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ ব্যবহার-সংক্রান্ত পদক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ১২ কোটি ভোটারের জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। গত ১৫ বছর ধরে আমাদের মানুষ একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এখন তারা ফেব্রুয়ারির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বলে জানান তিনি। একই দিনে কসোভোর প্রেসিডেন্ট ভিওসা ওসমানির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অধিবেশনের ফাঁকে সাইডলাইনে এ বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গ আলোচনা হয় বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে। ক্লাব ডি মাদ্রিদের সভাপতি ও স্লোভেনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দানিলো তুর্ক প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তার সংগঠনের সদস্য হতে আমন্ত্রণ জানান।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রে একটি হোটেলে এই বৈঠককালে দানিলো তুর্ক ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে অধ্যাপক ইউনূসের পথপ্রদর্শকমূলক কাজের প্রশংসা এবং এর বৈশ্বিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা সম্মানিত হব যদি আপনি আমাদের কর্মসূচিতে অংশ নেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক রূপান্তর বিষয়ে আপনার মতামত আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়ন করব। বাংলাদেশে সা¤প্রতিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ টেনে দানিলো তুর্ক বলেন, এ আন্দোলন দুনিয়াকে বিস্মিত করেছে এবং এ ধরনের রূপান্তর সম্পর্কে বৈশ্বিক নেতাদের আরো ভালোভাবে জানা দরকার।
মার্কিন কোম্পানিকে বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
‘অগ্রসর সংস্কার, স্থিতিস্থাপকতা এবং প্রবৃদ্ধি’ শীর্ষক ইউএস-বাংলাদেশ এক্সিকিউটিভ বিজনেস রাউন্ড টেবিলে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা। এতে সফররত বাংলাদেশের ৫টি রাজনৈতিক নেতারা অংশ নেন। মার্কিন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ এক্সিকিউটিভ বিজনেস গোলটেবিল আলোচনায় ড. ইউনূস বলেন- মেটলাইফ, শেভরন ও এক্সেলেরেটসহ শীর্ষ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগের আহ্বান জানান।