×

মুক্তচিন্তা

ধর্মীয় শিক্ষা ও নেতৃত্বের নৈতিকতা

বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৫২ এএম

বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। ছবি: গুগল এআই স্টুডিও

নেতৃত্ব মানবসমাজের স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচার এবং মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার অন্যতম মূল ভিত্তি। একজন যোগ্য নেতাকে নির্বাচন বা নিযুক্ত করা কেবল রাজনৈতিক বা নাগরিক কর্তব্য নয়—এটি এক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্বও বটে। বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলো—খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, ইহুদি ধর্ম, হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম—প্রতিটিই নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে একজন নেতা কেমন হওয়া উচিত এবং সমাজের মানুষ কীভাবে তাঁদের নির্বাচন করবে। নিচে এসব মৌলিক শিক্ষার মূলভাবকে সংক্ষেপে তুলে ধরে আজকের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করা হলো।

খ্রিস্টীয় শিক্ষায় নেতৃত্বকে মূলত সেবামূলক দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়। বাইবেলের নতুন নিয়মে যিশু খ্রিস্ট বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড়, সে-ই তোমাদের সেবক হবে” (ম্যাথিউ ২৩:১১)। পাস্তোরাল গ্রন্থগুলোতে নেতার জন্য নির্দোষতা, আত্মসংযম, অতিথিপরায়ণতা ও শিক্ষাদানের ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে (১ তিমথি ৩:২)। অতএব খ্রিস্টীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যোগ্য নেতৃত্ব মানে বিনয়, করুণা, ন্যায়পরায়ণতা এবং জনগণের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ মনোভাব।

ইসলামে নেতৃত্বের মূল ভিত্তি হলো ন্যায় ও পরামর্শ (শূরা)। কুরআনে বলা হয়েছে, “আমানত তার প্রাপকের কাছে পৌঁছানো এবং বিচারকরা ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার করবে”— এটাই আল্লাহর আদেশ (সূরা নিসা ৪:৫৮)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে দুর্নীতিগ্রস্ত বা অযোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদান করা উচিত নয়; বরং জ্ঞান, সততা (আমানাহ) ও জবাবদিহিতাই ইসলামী নেতৃত্বের মূল মানদণ্ড। অতএব মুসলিম সমাজে ভোটার ও নাগরিকদের কর্তব্য হলো সৎ, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ প্রার্থীদের সমর্থন করা।

ইহুদি শিক্ষায়ও ন্যায়বিচার, জ্ঞান ও ঈশ্বরীয় বিধান মেনে চলা নেতৃত্বের জন্য অপরিহার্য। ব্যবস্থাবিবরণীতে নির্দেশ আছে বিচারক ও শাসক নিয়োগ করার এবং তাদের সঠিকভাবে বিচার করার জন্য (ব্যবস্থাবিবরণী ১৬:১৮)। তালমুদ ও অন্যান্য গ্রন্থে নেতৃত্বযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে জ্ঞান, নম্রতা ও সত্যনিষ্ঠার গুরুত্ব বারবার চিহ্নিত হয়েছে। ফলে ইহুদি প্রেক্ষাপটে যোগ্য নেতা হলেন এমন একজন, যিনি বিচার রক্ষা করবেন, দুর্নীতি এড়াবেন এবং সবার মর্যাদা রক্ষায় কাজ করবেন।

হিন্দুধর্মে আদর্শ শাসককে ‘রাজর্ষি’ বলা হয়েছে—যিনি জ্ঞান, আত্মসংযম ও ধর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে শাসন করেন। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে শ্রেষ্ঠদের আচরণ সাধারণ মানুষকে অনুকরণ করায়, নেতা হওয়া মানেই দায়িত্বপূর্ণ ও নৈতিক আচরণ প্রদর্শন করা। প্রাচীন অর্থশাস্ত্রও শাসনের ক্ষেত্রে যোগ্যতা, শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার ওপর জোর দিয়েছে। তাই হিন্দু দর্শনে উত্তম নেতা হলেন জ্ঞানী, নৈতিক ও জনগণের সেবায় নিবেদিত ব্যক্তি।

বৌদ্ধধর্মে নেতৃত্ব করুণার উপর প্রতিষ্ঠিত। ‘দশ রাজধর্মে’ শাসকের গুণাবলির মধ্যে দানশীলতা, নৈতিকতা, সততা, আত্মসংযম ও অহিংসাকে উচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে। গৌতম বুদ্ধ নির্বাচিত নেতাকে জনগণের কল্যাণ নিজের বিলাসিতা ও স্বার্থের চেয়ে ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধ নীতিগুলো শান্তি, সংহতি ও নৈতিকতায় টিকে থাকার নির্দেশ দেয়।

এভাবে সব ধর্মীয় শিক্ষা মিলিয়ে যে কয়েকটি সাধারণ নীতিমালা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো—ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও আমানতদারিত্ব, জনসেবার মনোভাব, প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা এবং জবাবদিহিতা। এই মৌলিক গুণাবলি যদি নেতাদের মধ্যে থাকে তবে জনগণের কল্যাণ, মানব মর্যাদা ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় তা অত্যন্ত সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় এ সব শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময় ধরে দুর্নীতি, স্বার্থসিদ্ধি ও ভোটকেন্দ্রে অনৈতিক প্রভাব দেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ভোটদানকে মুক্ত রাখা এবং ভোটারদের মধ্যে নৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হতে হবে—কোনো বুথেই ভোট বিক্রি করব না, কোনো অযোগ্যকে ক্ষমতায় বসাব না; যেন পূর্বের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয়।

শেষে বলি, প্রথমত, সতর্ক থাকতে হবে: ভুলভাবে অসৎ বা অযোগ্য নেতাকে নির্বাচিত করে দেশের উন্নয়ন ও জনকল্যাণ ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।

দ্বিতীয়ত, আহ্বান জানাই: প্রতিটি ভোটারকে নৈতিক ও বিবেচ্য মানদণ্ডে ভোট প্রদান করতে হবে; অর্থ বা স্বল্পমেয়াদি সুবিধার বিনিময়ে গণতান্ত্রিক অধিকার উৎসর্গ করা ঠিক নয়।

তৃতীয়ত, আশা রাখি: যদি আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে জবাবদিহিতা, ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধকে উচ্চে রাখি, তবে সমাজে এমন নেতৃত্ব আসবে, যা দক্ষতার সঙ্গে শাসন করবে এবং ন্যায়, শান্তি ও মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।

আজ বাংলাদেশে ভোট ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে নানা আলোচনা চলছে—আমরা ‘পিআর’ (Proportional Representation) পদ্ধতির কথা বলছি, নতুন কোনো পদ্ধতির খোঁজ করছি। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, কেবল পদ্ধতি বদলালেই আসল পরিবর্তন আসে না। যদি মানুষের অন্তর কলুষিত থাকে, তবে যেকোনো পদ্ধতি—পিআর হোক বা অন্য কিছু—শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়বে।

মানবজাতির সকল মহান ধর্ম এবং প্রতিটি জাগ্রত বিবেক একই সত্য উচ্চারণ করেছে—নৈতিকতা, মানবিকতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সুন্দরতম জীবনযাপনের আহ্বান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতসব দিকনির্দেশনা হাজার বছরের ইতিহাস জুড়ে থাকলেও আমরা কেন আজও সেগুলোর বাস্তবায়নে ব্যর্থ? কারণটি বাহ্যিক নয়, অন্তরের। নীতি ও আদর্শের কথা বলা সহজ, কিন্তু হৃদয়ের ভেতর পরিবর্তন না এলে কোনো সংস্কারই স্থায়ী হয় না। সভ্যতার ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—বাহ্যিক আইন, শিক্ষা কিংবা শাসনব্যবস্থা যথেষ্ট নয়; অন্তর যদি শুদ্ধ না হয়, তবে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

সত্যিকার নেতৃত্ব বা সামাজিক রূপান্তর কখনোই কেবল শব্দ বা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আসে না; আসে অন্তরের সৌন্দর্য, সততা এবং ন্যায়কে বরণ করার সাহস থেকে। অন্তর যদি কলুষিত থাকে, তবে সাধনা বিফল হবেই; অন্তর যদি আলোকিত হয়, তবে সামান্যতম পদক্ষেপও এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]


সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

ধর্মীয় শিক্ষা ও নেতৃত্বের নৈতিকতা বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

আজকের বাংলাদেশ গুজব, বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তায় ভরা

তরুণ প্রজন্মের চোখে আজকের বাংলাদেশ গুজব, বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তায় ভরা

পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে আগে দরকার প্রশাসনিক সংস্কার

পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে আগে দরকার প্রশাসনিক সংস্কার

জাতিসংঘ: পতনের ছায়া নাকি পুনর্জাগরণের আলো?

জাতিসংঘ: পতনের ছায়া নাকি পুনর্জাগরণের আলো?

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App