×

মুক্তচিন্তা

পরিবারতন্ত্রের দুষ্টচক্র

শেখ হাসিনা থেকে তারেক রহমান: ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব কি?

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৯ পিএম

শেখ হাসিনা থেকে তারেক রহমান: ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব কি?

শেখ হাসিনা ও তারেক রহমান

রাজতন্ত্রের পতনের পর সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এসেছে মুক্তির আশায়। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের স্বপ্ন বারবার পরিবারতন্ত্রের শিকলে ভেঙে গেছে। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরীফ পরিবার, ভারতে নেহরু–গান্ধী পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বান্দারনায়েক ও রাজাপাকসে পরিবার—সব জায়গায় পরিবারতন্ত্র গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শেখ হাসিনা, এবং এখন জিয়া পরিবার থেকে তারেক রহমান—বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি।

বারবার বলা হচ্ছে—পরিবার নয়, জনগণই গণতন্ত্রের প্রকৃত ভিত্তি। অথচ আমরা সে পথে না গিয়ে বারবার পথভ্রষ্ট হচ্ছি। পরিবারতন্ত্র মানে হলো ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তর, যেখানে জনগণের ইচ্ছা নয়, বংশপরিচয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করে। এর ক্ষতিকর প্রভাব স্পষ্ট: যোগ্যতার পরিবর্তে আনুগত্য রাজনীতিতে প্রাধান্য পায়, প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা দুর্বল হয়। দুর্নীতি ও দলীয়করণ সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ গণতন্ত্র থেকে বিমুখ হয়ে যায়। যখন রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক হয়, তখন গণতন্ত্র রাজতন্ত্রের ছদ্মবেশে পরিণত হয়।

শেখ হাসিনা উন্নয়নের নামে কিছু প্রকল্প দেখালেও তাঁর শাসনের চিহ্ন হিসেবে দেখা যায় বিরোধী দমন, ভোটাধিকার হরণ, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার দলীয়করণ এবং দুর্নীতি ও ভয়ের সংস্কৃতি। একজন বাবা হারা শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত দেশ হারা হলেন—এটাই পরিবারতন্ত্রের নির্মম পরিণতি। তার পতন প্রমাণ করে, পরিবারতন্ত্র যতই শক্তিশালী মনে হোক, একদিন তা ধসে পড়বেই।

শেখ হাসিনার ব্যর্থতা কি বিএনপিকে নতুন দিশা দিয়েছে? দুঃখজনকভাবে না। বিএনপির ইতিহাসে জিয়া পরিবারকেন্দ্রিকতা বরাবরই প্রবল। খালেদা জিয়ার পর এখন তারেক রহমানকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা চলছে। তিনি জনগণের আস্থা বা রাজনৈতিক যোগ্যতায় নয়, বরং বংশপরিচয়ের কারণে এগিয়ে আসছেন। শেখ হাসিনাকে পরিবারতন্ত্রের দায়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে, সমালোচনা চলছে, কিন্তু বিএনপি যদি একই ফাঁদে পা দেয়, তাদের বৈধতা কোথায় দাঁড়াবে—ভাবা দরকার।

বিশ্ব ইতিহাস সাক্ষী। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার সামরিক অভ্যুত্থানে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবার পতনের পর দেশ দেউলিয়া হয়েছে। ভারতে গান্ধী পরিবারের প্রভাব কমে আঞ্চলিক নেতৃত্ব শক্তিশালী হয়েছে। গবেষণাও বলছে, ডাইনাস্টিক রাজনীতি অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে, দুর্নীতি বাড়ায়, জনগণের আস্থা কমায়। এক ব্যর্থতা থেকে যদি শিক্ষা না নেওয়া হয়, তবে সেই ব্যর্থতাই নতুন ব্যর্থতার জন্ম দেয়। বাংলাদেশ আজ সেই দুষ্টচক্রেই বন্দি।

বিএনপির অতীত শাসনকাল দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। সরকারি তহবিল ও প্রকল্প বরাদ্দে অসদাচরণ এবং অনিয়ম বেড়েছে। বিরোধী দলের ওপর গুম, খুন এবং নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দমন করা হয়েছে। পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় কাজে ব্যবহার হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে যে গুম-খুন ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ঘটেছে, এর মাত্রা আসলেই কমেছে কি না—সেটা বলা কঠিন।

শেখ হাসিনার পতনের পর গত ১৪ মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্যবাঁধনের সুযোগে বিএনপি দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে শুধু চাঁদাবাজি ও ধান্দাবাজিই বৃদ্ধি করেনি, বরং জনগণের আস্থা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিক কাঠামোকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের অপকর্ম চালিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলেও সরকারি তহবিল ও প্রকল্প বরাদ্দে অসদাচরণ এবং অনিয়ম বেড়েছে। ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর রাজনৈতিক চাপ, হয়রানি এবং ভয় পরিস্থিতি আরও জোরদার হয়েছে। এই চিত্র শুধু অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতাকে প্রকাশ করে না, বরং দেখায় যে ইতিহাসের শিক্ষা না নেওয়া হলে পুনরাবৃত্তি অবধারিত। যদি বিএনপি পরিবারতন্ত্রের হাত ধরে আবারও ক্ষমতায় আসে, তবে দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের স্বার্থের জন্য সঙ্কট আরও গভীর হবে।

এই দুষ্টচক্র ভাঙার জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে—নেতৃত্ব নির্বাচন হোক ভোট ও মেধার ভিত্তিতে, বংশের নয়। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে—প্রার্থীর যোগ্যতা, আর্থিক অবস্থা ও অতীত প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হোক। ক্যাম্পেইন অর্থায়ন সংস্কার করতে হবে—রাজনৈতিক তহবিলের উৎস প্রকাশ করা হোক। নেপোটিজম বিরোধী আইন কার্যকর করতে হবে—প্রশাসনে স্বজনপ্রীতির সুযোগ বন্ধ করতে হবে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে—নির্বাচন ও তদন্ত সংস্থা নির্বাহী প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ করতে হবে—পরিবার ছাড়া সমাজের নানা স্তর থেকে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে—তাহলেই নাগরিকদের কণ্ঠস্বর নিশ্চিহ্ন হবে না।

বাংলাদেশের জনগণের সামনে আজ মূল প্রশ্ন হলো, আমরা কি আবারও পরিবার বনাম পরিবার খেলায় বন্দি থাকব, নাকি জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতি গড়ে তুলব? শেখ হাসিনা পরিবারতন্ত্রের কারণে দেশ হারালেন। বিএনপি যদি একই পথে হাঁটে, তার ফলাফলও ভিন্ন হবে না। এখন সময়—নতুন শিক্ষা নেওয়ার। পরিবার নয়, জনগণ; বংশ নয়, যোগ্যতা। অন্যথায় ইতিহাস বারবার আমাদের শিখিয়ে দেবে, কিন্তু আমরা বারবার একই ভুলে পতিত হব।

শেষে বলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক জাতির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য কিছু ওয়ার্ল্ড ক্লাস নীতি অপরিহার্য: নেতৃত্ব নির্বাচন হোক যোগ্যতা, নৈতিকতা ও জনমতের ভিত্তিতে। শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে, যাতে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার রাজনীতি ও প্রশাসনে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা সর্বোচ্চ রক্ষা করতে হবে। যুব ও নতুন নেতৃত্বের বিকাশে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারে। এই নীতিগুলো বাস্তবায়ন ছাড়া বাংলাদেশ কখনোই পরিবারতন্ত্রের চক্র থেকে মুক্তি পাবে না এবং জনগণকেন্দ্রিক, স্বচ্ছ ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। ইতিহাস শিক্ষা দেয়, কিন্তু আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা এবং দৃঢ় প্রয়াস—তার মাধ্যমেই দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা সম্ভব।

জাগো বাংলাদেশ, জাগো।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

হজের ৩ প্যাকেজ ঘোষণা করলো অন্তর্বর্তী সরকার

হজের ৩ প্যাকেজ ঘোষণা করলো অন্তর্বর্তী সরকার

খাগড়াছড়ির গুইমারায় ১৪৪ ধারার মধ্যেই সহিংসতা, নিহত ৩

খাগড়াছড়ির গুইমারায় ১৪৪ ধারার মধ্যেই সহিংসতা, নিহত ৩

পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠালো ভারত, একাদশে যারা

এশিয়া কাপ ফাইনাল পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠালো ভারত, একাদশে যারা

অপরাধের রমরমার মধ্যে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি!

সীমান্ত পথে দেশে ঢুকছে অস্ত্র অপরাধের রমরমার মধ্যে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি!

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App