×

মুক্তচিন্তা

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৩ পিএম

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস নিয়ে সুইডেন থেকে লিখেছেন রহমান মৃধা

সময়, কাল, পাত্র এবং স্থানভেদে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছি। জানা-অজানা তথ্যের কিছু অংশ শেয়ার করেছি গণমাধ্যমে, কিছু একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় আছে যা হয়তো কখনও কেউ জানতে পারবে না; তা শুধু নিজের জন্য রেখে দিয়েছি। নিজের জন্য রেখে দেওয়া ঘটনাগুলো মনের মাঝে লুকিয়ে থাকে, আবার হঠাৎ ঘটনাচক্রে ফিরে আসে। ঠিক প্রায় চৌত্রিশ বছর আগে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় স্টকহোমে, মারিয়ার মাধ্যমে, মারিয়া আমার সহধর্মিণী।

মারিয়া পরিচয় করিয়ে দিলো, “আমার বড় বোন জেইন।” আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং বললাম, “রহমান।” জেইন বয়সে মারিয়ার থেকে চৌদ্দ বছরের বড়। জেইনের বয়স তখন সম্ভবত চল্লিশ বছর আমার সঙ্গে যখন তার প্রথম দেখা। আমাদেরকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলো। স্টকহোম ম্যালারেনের পাশে বেশ সুন্দর একটি জায়গায় জেইন চার রুমের একটি বাসায় একা থাকে। আমি মারিয়াকে জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম, ঠিক তখন জেইন নিজে থেকেই বললো, “আমি সিঙ্গেল, একা থাকি এই বাসায়।”

জীবনের প্রথম পরিচয় মারিয়ার বোনের সঙ্গে, তারপর আমি নিজেই সবে মারিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। অনেক তথ্য যেমন জানানো হয়নি, ঠিক তেমনি জানতেও পারিনি। জেইনের সঙ্গে প্রথম দেখা স্বল্প সময়, অল্প কথা; তার সঙ্গে সুইডিশ ফিকা, চা-কফির আড্ডা চলছে। হঠাৎ ঘড়িতে দেখি বিকেল ছয়টা বাজে। আমাদের আবার ডিনারের দাওয়াত পড়েছে ঠিক সেদিনই রাতে মারিয়ার বাবা-মার বাড়িতে। আমরা ফিকা সেরে চলে গেলাম মারিয়ার বাবা-মার বাড়িতে। যেতে যেতে পথে মারিয়া জেইন সম্পর্কে সংক্ষেপে আরো বেশ কিছু তথ্য দিলো।

জেইনের বাড়ি থেকে মারিয়ার বাবা-মার বাড়ির দূরত্ব ট্রেনে মাত্র পনেরো মিনিট সময় লাগে, তো বেশি কিছু জানা গেলো না এতো অল্প সময়ের মধ্যে। আমরা মারিয়ার বাবা-মার বাড়িতে ডিনারে এসে পৌঁছে গেলাম। এখানেও আমি নতুন, এই প্রথম পরিচয় মারিয়ার বাবা-মার সঙ্গে। ঘরে ঢুকতেই মনে হলো, বেশ নতুন পরিবেশে ঢুকলাম।

ডিনার রান্না করেছেন আন্টোনিও; ভ্যালেন্সিয়ার স্পেশাল খাবার পায়েলা (Paella)। ডিনার টেবিলে কথোপকথন চলাকালীন অনেক কিছু জানা গেল, যেমন স্টকহোম ওডেনপ্লানে আন্টোনিও এবং বিরগিত বহু বছর ধরে বসবাস করছেন। আন্টোনিও মূলত কেটিএইচ-এ (স্টকহোম রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, সুইডেনে এটি অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) লেখাপড়ার সুবাদে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া থেকে স্টকহোমে আসেন এবং পরবর্তীতে বিরগিতের সঙ্গে প্রণয়ে আবদ্ধ হন। বিরগিত এবং আন্টোনিওর দাম্পত্য জীবনে মারিয়া আন্টোনিওর একমাত্র কন্যা; কিন্তু বিরগিতের প্রথম বিবাহ হয় ওকে ব্যারির সঙ্গে এবং তাদের দুই সন্তানের জন্ম হয়, জেইন ও এভা। ওকে ব্যারির সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর বিরগিত দ্বিতীয় বিবাহ করেন আন্টোনিওকে।

এতক্ষণে আমার বোধগম্য হলো, জেইন মারিয়ার স্টেপসিস্টার। আমার ভাবনার জগতে জেইন বেশ বাসা বাঁধে। মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার বোন একা কেন, দেখতে শুনতে ভালো, চাকরি-বাকরি সহ সবকিছু আছে, অথচ একা; কারণ কী?” যদিও আমি আট বছর ধরে সুইডেনে বসবাস করছি, সুইডিশ জীবন সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা আছে, তবুও জেইন সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে গেল।

মারিয়া যখন জেইনের কথা বলতে শুরু করল, তখন বুঝলাম, ষাটের দশকের স্টকহোমে জেইন ছিল এক নতুন ধরনের তরুণী; সেই সময়ের নীরব সমাজের ভেতরও তার মধ্যে ছিল অন্যরকম আলোড়ন। ষাটের দশকের শুরুতে জেইন ছিল মাত্র দশ থেকে এগারো বছর। সুইডেন তখনও নিরাপদ, নীরব ও সুশৃঙ্খল, এক স্থিতিশীল ফল্কহেম (folkhem)। ফল্কহেম ধারণাটি ১৯৩০-এর দশকে সুইডেনের সমাজতান্ত্রিক নেতা পার আলবিন হ্যানসন জনপ্রিয় করেন। তিনি বলেছিলেন, “সুইডেন হবে এক ফল্কহেম, যেখানে সমাজ হবে এক পরিবারের মতো; কেউ থাকবে না প্রভু, কেউ থাকবে না দাস।”

অর্থাৎ রাষ্ট্র হবে এমন এক ঘর, যেখানে সব নাগরিকের সমান মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অধিকার থাকবে। বাবা ওকে অফিসে কাজ করতেন, মা বিরগিত অফিস এবং সংসার সামলাতেন, ছোট বোন এভা স্কুলে যেত। সবকিছু যেন পূর্বনির্ধারিত; দায়িত্ব, শৃঙ্খলা, নীরব আনন্দ। কিন্তু জেইনের ভেতরে যেন অন্য এক সময় ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। রেডিওর নতুন সুর, সিনেমার পর্দায় ঝলমলে তরুণ মুখ, আর বাতাসে ভেসে আসা অচেনা এক শব্দ, স্বাধীনতা।

এরপর এলো ষাটের দশক, এক নতুন প্রজন্মের উত্থানের সময়। স্টকহোম যেন হঠাৎ রঙিন ও সাহসী হয়ে উঠল; মেয়েরা কথা বলতে শিখল নিজেদের হয়ে। যখন জেইন মাধ্যমিক স্কুলে উঠল, তখন স্টকহোম বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। শহরটা যেন আরো আলোকিত, রঙিন ও তরুণ হয়ে উঠেছে। পোশাকের রঙ উজ্জ্বল হয়েছে, চুলের ছাঁট হয়েছে সাহসী, আর মেয়েরা শিখছে নিজেদের হয়ে কথা বলতে। জেইন আর তার বন্ধুরা শুনত বিটলস ও হেপ স্টারসের গান, পড়ত পপ ম্যাগাজিন, বিনিময় করত রেকর্ড, আর ভাবত, একদিন হয়তো তারাও লিখবে, গান গাইবে, ভ্রমণ করবে, নিজেদের মতো করে বাঁচবে। জিন্স পরা তখন একরকম ঘোষণা, পুরনো নিয়মের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। স্কুলে এখন আর সবাই চুপচাপ বসে থাকে না; মেয়েরাও মতামত দেয়, প্রশ্ন করে, হাসে জোরে।

কিন্তু এই মুক্তির ভেতরেই শুরু হলো নিষিদ্ধ কথার যুগ। শরীর, ভালোবাসা ও স্বাধীনতা নিয়ে যা এতদিন চাপা ছিল, তা আলোয় আসতে লাগল। সেই সময়েই পৃথিবীর সঙ্গে জেইনের চিন্তার সম্পর্ক বদলে গেল। সে পড়ল সিমোন দ্য বোভোয়ার, শুনল টেগে ড্যানিয়েলসনের ব্যঙ্গ, আর বুঝল নারীর জীবনও হতে পারে নিজের হাতে গড়া।

স্কুলে প্রথমবার যৌনশিক্ষা চালু হলো। শিক্ষকের মুখ লাল, ছাত্রীরা করে ফিসফিস, ছেলেরা হাসে। তবু জেইনের মনে হলো, এটাই তো সাহসের শুরু। মানুষের দেহ, ভালোবাসা, স্বাধীনতা,  সবকিছুই আর লজ্জার নয়, আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে। সে দেখল মেয়েরা নিজেদের ইচ্ছায় ডাক্তার দেখাচ্ছে, নিজেদের শরীর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই নবীন পৃথিবী ছিল অচেনা, কিন্তু তীব্রভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠলো।

এদিকে ঘরের ভেতর কিন্তু সময় যেন থেমে আছে। পুরনো প্রজন্ম নতুন ভাবনার ভেতর অস্থির হয়ে উঠছে; বাবা চিন্তিত, মা উদ্বিগ্ন, কোথায় গিয়ে থামবে এই বদল? যখন জেইন কোনো রাতে রাতজাগা তরুণদের মিলনমেলা নৃত্যসভা থেকে দেরিতে ফেরে, বাবা ওকের মুখে উদ্বেগ, মা বিরগিতের চোখে প্রশ্ন। তবু জেইন জানে, এটা আর শুধু অন্যদের ভালো-মন্দের প্রশ্ন নয়; এটা তার নিজের জীবন বেছে নেওয়ার অধিকার।

ক্রমে জেইনের ভাবনার দিগন্ত আরও প্রসারিত হলো। সে নামল রাস্তায়, হাতে নিল শান্তির ব্যানার, লিখল দেয়ালপত্রিকায় নারীর স্বাধীনতার কথা। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সবকিছু হয়ে উঠল আরও রাজনৈতিক। জেইন অংশ নেয় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী মিছিলে, শান্তির প্রতীক আঁকা ব্যানার হাতে হাঁটে স্টকহোমের রাস্তায়।

সে স্কুলের দেয়ালপত্রিকায় লেখে নারীর অধিকার, শিক্ষার সুযোগ এবং স্বাধীন চিন্তার কথা। দেশজুড়ে পরিবর্তনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে- গর্ভপাত, কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার, লিঙ্গ সমতা; সবকিছু নিয়ে খোলাখুলি কথা হচ্ছে। এটি আর কেবল সঙ্গীতের যুগ নয়; এটি চিন্তার জাগরণের যুগ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বিশ্বাসও পাল্টে গেল। ঈশ্বরকে আর গির্জায় নয়, খুঁজতে লাগল মানুষের ভেতরের সাহসে, স্বাধীনতায়। গির্জার বেঞ্চগুলো ফাঁকা হতে শুরু করেছে। যুবক-যুবতীরা আর রবিবারে সেখানে যায় না।

জেইনও কেবল বড়দিনে পরিবারের খাতিরে যায়, কিন্তু তার বিশ্বাস এখন অন্যরকম। মানুষের ভেতরের শক্তিতেই সে ঈশ্বরকে খুঁজে পায়। ডায়েরিতে সে লেখে, “যদি ঈশ্বর সত্যিই থাকেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই স্বাধীনতার পক্ষেই আছেন।”

ষাটের দশকের শেষে জেইন যখন নিজের পথে বেরিয়ে পড়ল, তখনই প্রথম বুঝল, নিজের হাতে গড়া জীবনই আসল স্বাধীনতা। ষাটের দশকের শেষে জেইন উনিশ বছর বয়সে পা রাখে। সে পরিবার ছেড়ে বেরিয়েছে, ভাড়া নিয়েছে এক ছোট ঘর, ভর্তি হয়েছে সাংবাদিকতায়।

নিজের উপার্জনে বাঁচা, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং নিজের কণ্ঠে কথা বলা, এই প্রথম সত্যি স্বাধীনতা অনুভব করে। সে এখন লেখে মেয়েদের গল্প, যারা সাহস করে ভালোবাসে, কাজ করে এবং ভাবছে। আর তার কলমে ধরা পরে নতুন সুইডেনের চেহারা, একটি সমাজ যেখানে মানুষ প্রথমবার নিজের মতো করে বাঁচতে শিখছে। এইভাবে ষাটের দশক শুধু জেইনের জীবন নয়, বদলে দিলো এক পুরো প্রজন্মকে। মানুষ শিখল প্রশ্ন করতে, প্রতিবাদ করতে, আর ভালোবাসতে। সত্যিই, এক নতুন সময়ের জন্ম হয়েছিল।

এতক্ষণে বুঝলাম কেন জেইন একাকীত্বকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। যাই হোক, জেইনের সঙ্গে বহু বছরের সম্পর্ক। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে জেইন বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে, জর্জ হ্যারিসন এবং রবি শঙ্কর ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। এই কনসার্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা এবং বিশ্বকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো। জেইন সেই কনসার্টে অংশগ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে স্টকহোমের রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। শুনেছি তার মুখে এসব কথা। ১৯৯৬ সালে আমাদের সঙ্গে সে একবার বাংলাদেশ গিয়েছিল।

জেইন স্টকহোম শহর ছেড়ে সুইডেনের গ্রামে বহু বছর ধরে বসবাস করছে। গতকাল তার বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আজ আমাদের পরিচিত একজন মানুষ মারা গেলেন। মৃত্যুকালে জেইনের বয়স ছিল ৭৩ (তেহাত্তর) বছর। জেইন তার গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেছেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতামূলক মানববন্ধন

ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতামূলক মানববন্ধন

মেডিকেল ট্যুরিজমে চমক এনেছে সুহা ট্রাভেলস থাইল্যান্ড

মেডিকেল ট্যুরিজমে চমক এনেছে সুহা ট্রাভেলস থাইল্যান্ড

সিংগাইরে মাদ্রাসায় বসার বেঞ্চ-টুল উপহার দিলো জেসিআই মানিকগঞ্জ

সিংগাইরে মাদ্রাসায় বসার বেঞ্চ-টুল উপহার দিলো জেসিআই মানিকগঞ্জ

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App