বিদেশীদের কাছে বন্দর ইজারা: আমাদের লাভ-ক্ষতি
সাইফুল ইসলাম শান্ত
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:১৯ পিএম
বিদেশীদের কাছে বন্দর ইজারা: আমাদের লাভ-ক্ষতি
বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে সমুদ্র বন্দরগুলোর সম্পর্ক যেন শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো জড়িত। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা এই তিনটি সমুদ্র বন্দরই দেশের আমদানি–রপ্তানির প্রধান প্রবেশদ্বার। শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই দেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়। অর্থাৎ, বন্দর স্থবির হলে পুরো অর্থনীতি থমকে দাঁড়াবে। তাই বন্দরগুলোর উন্নয়ন, আধুনিকায়ন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা জাতীয় স্বার্থের জন্যই প্রয়োজন। এই বাস্তবতার মধ্যেই চট্টগ্রামের লালদিয়া টার্মিনালসহ কয়েকটি প্রকল্প বিদেশি অপারেটরের কাছে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক। কেউ বলছেন এটি ‘বন্দর বেচে দেওয়া’, আবার কেউ বলছেন এটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত ‘পাবলিক–প্রাইভেট অংশীদারিত্ব’। কিন্তু প্রশ্ন হলো এমন সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক, নাকি ঝুঁকিপূর্ণ?
প্রথমেই বুঝতে হবে, বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলো তাদের বন্দর ব্যবস্থাপনাকে অনেক আগেই বেসরকারি বা বিদেশি অপারেটরের কাছে দিয়েছে কারণ আধুনিক বন্দর পরিচালনা অত্যন্ত প্রযুক্তিনির্ভর এবং মূলধনসাপেক্ষ। উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার কথা বলা যায়। যেখানে চীনা কোম্পানি ৯৯ বছরের জন্য বন্দর পরিচালনা করছে। ভারতের মুণ্ড্রা, এনোর, কাকিনাড়া সবই বেসরকারি অপারেটরের অধীনে পরিচালিত হয়ে দেশটির বাণিজ্য গতিকে বহুগুণ বাড়িয়েছে। দুবাইয়ের ‘জেবেল আলি পোর্ট’ যা বিশ্বের সেরা বন্দরগুলোর একটি, যেটি পরিচালনা করছে ডিপি ওয়ার্ল্ড নামের একটি আন্তর্জাতিক বন্দর পরিচালনাকারী সংস্থা। একইভাবে পাকিস্তানের গাদার বন্দরও চীনা অপারেটরের হাতে। আধুনিক প্রযুক্তি, দ্রুত পণ্য খালাস, বৃহৎ বিদেশি বিনিয়োগ এসব কারণে অনেক দেশ বিদেশি অপারেটরকে অংশীদার করেছে এবং উপকৃতও হয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে বাংলাদেশ কি এই মডেল অনুসরণ করবে? বাস্তবতা হলো, গত ২০ বছরে আমাদের বন্দরগুলো অগ্রগতি করেছে কিন্তু বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এখনও বেশ পিছিয়ে আছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ‘ডুয়েল টাইম’ বা পণ্য খালাসের সময় অনেক বেশি, কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রযুক্তি পুরনো, শ্রম ব্যবস্থাপনায় জটিলতা রয়েছে এবং অবকাঠামো উন্নয়ন এখনো পর্যাপ্ত নয়। বৈশ্বিক মানদণ্ডে যেখানে ২০–৩০টি কনটেইনার প্রতিঘণ্টায় লোড–আনলোড হয়, সেখানে আমাদের বন্দরে এর কার্যকারিতা কম। তাই বেসরকারি বা বিদেশি অপারেটরদের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি থেকে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে উপকৃত হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দর দক্ষতা বাড়লে একটি দেশের রপ্তানি কমপক্ষে ২৫–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্য। গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যালস, কৃষিপণ্য সবকিছুই এখন দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। বন্দর আধুনিক না হলে, রপ্তানিকারকরা ধাক্কা খাবে। বৈশ্বিক ক্রেতারা অন্য দেশে চলে যাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে। তবে এ কথা সত্য যে, বিদেশি অপারেটরের কাছে বন্দর হস্তান্তর শুধু অর্থনৈতিক না, এটি জাতীয় নিরাপত্তা, কৌশলগত স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্বের সঙ্গেও সম্পর্কিত। অনেকেই আশঙ্কা করছেন—চট্টগ্রামের মতো কৌশলগত বন্দর বিদেশি কোম্পানির হাতে গেলে তারা হয়তো অপারেশনাল সুবিধা পাবে যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে। আবার সমালোচকরা আরও বলছেন, ইজারা দীর্ঘমেয়াদি হলে দেশ নিজস্ব দক্ষতা গড়ে তোলার সুযোগ হারাবে।
কিন্তু এই আশঙ্কাগুলো কতটা বাস্তবসম্মত? বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব দেশ বন্দর ইজারা দিয়েছে—তা পুরোপুরি মালিকানা হস্তান্তর নয়। বন্দর থাকে দেশের মালিকানায়। আর বিদেশি কোম্পানি কেবল পরিচালনায় দক্ষতা, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির যোগান দেয়। যেমন জেবেল আলি পোর্ট, হাম্বানটোটা, মুণ্ড্রা—সব ক্ষেত্রেই এমন মডেল কাজ করেছে। ভারত তার মুণ্ড্রা পোর্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের হাতে দিয়ে এখন বিশ্বের অন্যতম লাভজনক বন্দর পরিচালনার উদাহরণ তৈরি করেছে। সেখানে ভারতীয় রাষ্ট্র কোনো সার্বভৌমত্ব হারায়নি।
বাংলাদেশের জন্য বন্দর আধুনিকায়ন জরুরি—এটি আমরা সবাই চাই। কিন্তু মূল বিতর্ক হলো—এই সংস্কার কাদের মাধ্যমে হবে? স্থানীয় নাকি বিদেশি অপারেটর? স্থানীয় সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আমাদের অস্বীকার করা যাবে না। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে বহু বছর ব্যয় হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদেরকে আধুনিক বন্দর পরিচালনায় দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি আরও বাড়াতে হবে। বিদেশি অপারেটরদের হাতে থাকলে স্বচ্ছতা, গতি, প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক—এসব সুবিধা দ্রুত আসে। তবে বিদেশি অপারেটর বাছাইয়ে পূর্ণ স্বচ্ছতা অপরিহার্য। দরপত্র প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হলে জনগণের মনে প্রশ্ন উঠবে। দীর্ঘমেয়াদি ইজারা চুক্তিগুলোতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা, ব্যয়সীমা, কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ এবং অপারেশনাল দায়িত্বের ওপর নজরদারির স্পষ্ট শর্ত থাকতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এটি কি এখনই করা দরকার, নাকি সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত? অনেকে বলছেন, দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে বন্দর উন্নয়ন থেমে যাবে। কারণ বাণিজ্য প্রতিদিন বাড়ছে এবং চট্টগ্রাম বন্দর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন—হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে এমন কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথমে জনমত, বিশেষজ্ঞ মতামত ও সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বন্দর ইজারা প্রশ্নে তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। প্রতিটি বন্দর প্রকল্প রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে প্রভাবিত করে। এছাড়া বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে কাজের পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যাতে ভবিষ্যতে আমরা নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে বন্দর পরিচালনায় অভ্যস্ত হতে পারি।
সমস্যার সমাধানে সুপারিশ
বিদেশি অপারেটরকে ইজারা দেওয়ার আগে আর্থিক, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ঝুঁকির বিস্তারিত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সরাসরি দীর্ঘমেয়াদি ইজারার বদলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে বিনিয়োগ নেওয়া নিরাপদ ও লাভজনক।
বন্দর নিরাপত্তা, তথ্য নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক অধিকার, জরিমানা ধারা—এসব শর্ত স্পষ্টভাবে চুক্তিতে উল্লেখ করতে হবে।
শ্রীলঙ্কার মতো ভুল এড়াতে এবং ইউরোপ–মধ্যপ্রাচ্যের সফল বন্দর পরিচালনা মডেল অনুসরণ করতে হবে।
একক দেশ বা কোম্পানিকে নয়—বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করলে বাংলাদেশ আরও সুবিধাজনক শর্ত পাবে।
বন্দর ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি ও জনবল উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন যাতে বিদেশি নির্ভরতা কমে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ও ট্র্যাকিং–এ সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশন করে দুর্নীতি কমাতে হবে।
বন্দর ইজারা একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। তাই রাজনৈতিক চাপ বা তাড়াহুড়ো নয়—গভীর মূল্যায়ন ও জাতীয় ঐকমত্য জরুরি।
বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলো দক্ষিণ এশিয়ার ‘পরবর্তী বাণিজ্যকেন্দ্র’ হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, উৎপাদনশীল খাতের বৃদ্ধির হার, আঞ্চলিক বাজার—সবকিছুই আমাদের পক্ষে। তাই বন্দর উন্নয়ন বন্ধ রাখা বা পিছিয়ে থাকা কোনোভাবেই সমাধান হতে পারে না। আমাদের যৌক্তিক, স্বচ্ছ ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। অসম্পূর্ণ অবকাঠামো ও ধীরগতির বন্দর ব্যবস্থাপনা আমাদের অর্থনীতিকে ধীর করে দিচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশি অপারেটরের কাছে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর মাশুল দিতে হবে। তাই মাথা ঠাণ্ডা রেখে, স্বচ্ছভাবে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়নের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। বন্দর উন্নয়ন সেই অগ্রযাত্রার অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। এটি বিদেশিরা পরিচালনা করবে নাকি দেশীয় সক্ষমতা বাড়ানো হবে—এই বিতর্কের চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো: আমরা কি এমন সিদ্ধান্ত নেব যা দেশের স্বার্থ, অর্থনীতি ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে শক্তিশালী করবে? বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরবর্তী শক্তি হবে, নাকি সুযোগ হাতছাড়া করবে এই সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হবে।
লেখক: সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
