বাংলাদেশিদের ভিসা প্রত্যাখ্যান, নেপথ্যে যে কারণ

অনামিকা রায়
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১০:০৪ পিএম
বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য বিশ্বের দরজা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে উপসাগরীয় অঞ্চল, এমনকি পূর্ব ইউরোপ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে পর্যন্ত নজিরবিহীন ভিসা সংকটে পড়েছেন বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা।
সম্প্রতি অন্তত দুই ডজন দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা প্রক্রিয়া বন্ধ বা কঠোর করে তুলেছে। ট্যুর অপারেটর, ভুক্তভোগী এবং সরকারি সূত্র বলছে, ভিয়েতনাম, লাওস, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান ও মিশর ভিসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও এখন শুধু সীমিত চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্যাটাগরিতে ভিসা মিলছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর অবস্থান আরো কঠোর। নিয়োগ পর্যায়ের দুর্নীতি ও জাল সনদের ছড়াছড়ি বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরও বিপদে ফেলেছে। জাপান, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশগুলোও অনিয়মের কারণে ভিসা প্রায় বন্ধ করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ভিসা লঙ্ঘনকারীদের অন্তত ২৫ শতাংশ বাংলাদেশি।
২০২৪-এর গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে। নির্বাচন, নানা ইস্যু ঘিরে দেশের অভ্যন্তরে লাগাতার আন্দোলন, সহিংসতা, গণতান্ত্রিক সংকট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এ কারণে অনেক দেশ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা ইস্যুকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
এ বিষয়ে কূটনৈতিক স্তরে প্রচেষ্টা চললেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। ভ্রমণকারীদের প্রত্যাখ্যান ও দেশে ফেরত পাঠানোর মতো ঘটনা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। হংকং ও চীনে বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও বহু বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেকে অভিযোগ করছেন, বৈধ ভিসা থাকার পরও বিমানবন্দর থেকে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।
যদিও ঢাকায় চীনা দূতাবাস দাবি করেছে, তাদের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এর প্রভাবে শ্রমবাজারেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও মালয়েশিয়ার মতো প্রধান শ্রমবাজারগুলো অদক্ষ কর্মীর ভিসা বন্ধ করেছে। ফলে রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতি বেশ চাপে পড়েছে। পর্যটন খাতও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের তথ্য বলছে, বহির্গামী পর্যটন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে গেছে, কর্পোরেট ভ্রমণও হ্রাস পেয়েছে ৭০ শতাংশে। নতুন ভিসা জটিলতার কারণে ভারত, থাইল্যান্ডের মতো গন্তব্যগুলো জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ফলে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানের মতো বিকল্প গন্তব্যে চাপ বেড়েছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি বিমান ভাড়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট থেকে বের হতে হলে সবচেয়ে আগে দরকার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জালিয়াতি দমন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ। বিদেশগামী কর্মী ও পর্যটকদের আস্থার সংকট কাটাতে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতাও জোরদার করতে হবে। নাহলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভিসার দুয়ার আরও কঠিন হবে, যার প্রভাব সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে পড়বে।